Home সারাদেশ অযত্ন-অবহেলায় পাবনার মুক্তিযুদ্ধের একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ

অযত্ন-অবহেলায় পাবনার মুক্তিযুদ্ধের একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ

by Newsroom
অযত্ন-অবহেলায়

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাঁথা অবদান রয়েছে প্রাচীন জেলা পাবনার। নয়টি উপজেলার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে বধ্যভূমি, গণকবরসহ মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। ইতিহাসের সাক্ষী বানিয়ে রাখা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ আর মুক্তিযুদ্ধের নানা কারুকার্য খচিত ভাস্কর্য। যে চেতনায় এসব নির্মাণ করা হয়েছে, বর্তমানে তার মলিনতা ধরা পড়েছে। রয়েছে চরম অযত্ন-অবহেলায় ।

দূর্জয় পাবনা
জেলা সদরের কালেক্টরেক্ট ভবনের সামনে শেখ রাসেল শিশু পার্কের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে একাত্তরের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘দূর্জয় পাবনা’। তৎকালিন জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। ১৯৯৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এর উদ্বোধন করেন।

এতে জেলার ১৪৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম খোদাই করা আছে। এছাড়া পৃথক চারটি পাথরে লেখা আছে স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের অংশ বিশেষ, পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসম্পর্ণের দলিল এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতার চারটি পংক্তি- ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

তথ্যমতে, এই স্মৃতিসৌধের মূল বেদীটি ২৫ ফুট ব্যাসের। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতীক হিসেবে বেদীটি সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর ২৫ ফুট ব্যাস হলো- ২৫শে মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতীক। শোকের প্রতীক হিসেবে বসানো হয়েছে কালো মার্বেল।অযত্ন-অবহেলায়

এর দ্বিতীয় বেদীর ব্যাস ১৬ ফুট। এটা দিয়ে বিজয় দিবসকে বোঝানো হয়েছে। এই বেদীর উপরে রয়েছে নয় ফুট উচ্চতার চারটি মানব প্রতিকৃতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নয় মাসের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে। আর বাংলাদেশে চারটি মূলনীতি বোঝাতে এ মানবমূর্তিগুলো। এই দ্বিতীয় বেদী থেকে ২৬ ফুট স্তম্ভটি হলো- ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রতীক। আর সবার উপরে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা।

বিজয়ের সড়কদ্বীপ ও রাজাকারদের থুথুস্তম্ভ
পাবনার শহরের পরেই উপজেলা হিসেবে ঈশ্বরদী অবস্থান। এ উপজেলার আলহাজ্ব মিল সড়ক দ্বীপে নির্মাণ করা হয়েছে বিজয়ের স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধ ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি অবিস্মরণীয় করে রাখতে এই সড়ক দ্বীপ নির্মাণ করা হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায় নির্মাণ করা হয়েছে রাজাকারদের ঘৃণাস্তম্ভ।

ঘৃণাস্তম্ভে ‘তুই রাজাকার’, ‘তুই আলবদর’, ‘তুই শান্তি কমিটি’, ‘তুই যুদ্ধাপরাধী’, লেখা হয়েছে। বিজয়ের এই সড়কদ্বীপে মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পাশাপাশি পাশেই নির্মিত রাজাকারদের ঘৃণাস্তম্ভে থু থু ছিটিয়ে, লথি দিয়ে এবং জুতা মেরে রাজাকারদের ঘৃণা প্রদর্শণ করা হয়।

অপ্রতিরোধ্য চাটমোহর
জেলার চাটমোহর-পাবনা ও ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর সড়কের ভাদড়া নামক মোড়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘অপ্রতিরোধ্য চাটমোহর’ নামে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ১০ ফুট উচ্চতার অপ্রতিরোধ্য চাটমোহরের মূল বেদীর উপর পাঁচজন নারী-পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ভাস্কর্যের পেছনে একটি লাল সূর্য নির্মাণ করে দেন শিল্পী মৃণাল হক।

অযত্ন-অবহেলায়

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ভাঙ্গুড়া
জেলার ভাঙ্গুড়া উপজেলার বড়াল রেল ব্রিজের পাশে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে স্থানীয় সাংসদের উদ্যোগে এটি নির্মাণ করা হয়।

বাউশগাড়ী-ডেমড়া গণহত্যায় স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি
সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল জেলার ফরিদপুর উপজেলা ও সাঁথিয়ার সীমান্তবর্তী ডেমড়া ও বাউশগাড়ি এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রায় ৪৫০ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর গণকবর দেয়।

একই দিনে এই এলাকার ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্মরণে এই স্থানে ২০১১ সালে ডেমড়া মোড়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বাউশগাড়ী এলাকায় নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ও রূপসী সড়কে অসম্পন্ন রয়েছে স্মৃতিসৌধ।

বংশীপাড়া স্মৃতিসৌধ
জেলার আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া ইউনিয়নের চন্দ্রাবতী নদীর বংশীপাড়া ঘাটে ১৯৭১ সালে ৬ই নভেম্বর মুক্তিসেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পাবনায় অবস্থানরত পাকসেনাদের প্রায় ১০০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন তাহের খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করার জন্যে বংশীপাড়া ঘাটে পৌঁছায়।

অযত্ন-অবহেলায়

এ সময় রামচন্দ্রপুর ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা পাক-বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। সম্মুখ যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাহের খান মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। একই সঙ্গে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন এলাকার আবুল কালাম, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী ও নূর আলীসহ ২২জন নিরীহ গ্রামবাসী।

বংশীপাড়া যুদ্ধের সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে প্রচার করা হয়। বংশীপাড়া যুদ্ধের স্মৃতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা অম্লান করে রাখতে চন্দ্রাবতী নদীর তীরে বংশীপাড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ।

সাতবাড়িয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ
সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া গণহত্যা মানেই একাত্তরের ১২ মে সংগঠিত এবং পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যাকে বোঝায়। এদিন হানাদার বাহিনী সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও নিকটস্থ গ্রামে চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও লুটপাট। ১৫-২০ টি গ্রামের ৫০০-৬০০ মানুষকে হত্যা করা হয়।

এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনের লাশ পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফাসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পটভূমিতে স্বোচ্ছার ছিল এ এলাকা। পাবনা ২ আসনের প্রয়াত সাংসদ আহমেদ তফিজ উদ্দিন মাস্টারের বাড়ি ছিল এ এলাকায়।

অযত্ন-অবহেলায়

২০১৩ সালে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে সাতবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে নির্মাণ করা হয় গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে এ স্মৃতিস্তম্ভটি।

বীরবাঙালি
সাঁথিয়া উপজেলার একদিনে মুক্তিকামী জনতা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫০ জন সশস্ত্র পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে হত্যা করে। এদিনের যুদ্ধে পুলিশ, মুক্তিকামী জনতা, মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক মানুষ শহীদ হন। এটি ঐতিহাসিক ‘ডাববাগান যুদ্ধ দিবস’ হিসেবে পরিচিতি।

১৯ এপ্রিল এটি যুদ্ধ দিবস। শহীদ এই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০১ সালে তৎকালীন ডাববাগান ও বর্তমান শহীদনগরে ‘বীরবাঙালি’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। তৎকালের তথ্য প্রতিমন্ত্রী অদ্যাপক আবু সাইয়িদ এর উদ্বোধন করেন।

শেকড় থেকে শেখরে
জেলার বেড়ায় নগরবাড়ী-পাবনা মহাসড়ক সংলগ্ন ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের পাশে পাবনা-২ আসনের (বেড়া-সুজানগর) সাবেক সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক আরজু ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তরুণ শিল্পী বিপ্লব দত্ত প্রায় দেড় বছর নিরলস পরিশ্রমের পর নির্মাণ করেন বহুমাতৃক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এ ভাস্কর্য।

অযত্ন-অবহেলায়

১০ ফুট উঁচু কংক্রিটের স্তম্ভের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ ফুট উচ্চতার ও স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। দুই পাশে রয়েছে তিনটি করে অতিরিক্ত স্তম্ভ। মূল ভাস্কর্যের এক পাশে ২৬টি কলামের সীমানা বেষ্টনী রয়েছে। এই বেষ্টনীর প্রত্যেকটি কলামে সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ‘৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সচিত্র ইতিহাস।

সরেজমিনে জেলার প্রত্যেকটি ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্মৃতিসৌধগুলো ঘুরে দেখা যায়, নির্মাণের পর কিছুকাল রক্ষণাবেক্ষণে থাকলেও বর্তমানে জরাজীর্ণ এবং অযত্ন-অবহেলায় রাখা হয়েছে এই স্মৃতিগুলো। আগামি প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে এই স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ ও ভাস্কর্যগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলো যথাযথ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন মহল।

বর্তমানে অধিকাংস স্মৃতিসৌধ, স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্যগুলোতে ঘাসপাতা ও আগাছায় ভরপুর। এগুলোকে গরু ছাগল চড়ানোর উপযুক্ত স্থানে পরিণত হয়েছে। এগুলো বন্ধে স্থানীয়দের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক সামাজিক নেতৃবর্গসহ উপজেলা প্রশাসনের কঠোর নজরদারী ও ব্যবস্থা নেয়া জরুরী বলে মনে করেন তারা।

আরও পড়ুন : মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র বিক্রিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা

ভয়েস টিভি/এমএইচ

You may also like