আইয়ুব বাচ্চু কি রকস্টার ছিলেন? এমন প্রশ্ন কেউ তোলে না। তবে বাচ্চুর বিপরীতে হাওয়ায় উন্মাতাল স্রোতাদল বারবার ভেসেছে সাইকেডেলিক মহাসাগরে।
অচেনা হয়ে যাওয়া তোমার নাম ধরে বাচ্চু বলে উঠেছিলেন, সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে? বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে’। হ্যাঁ, তিনি সত্যি সত্যিই একদিন আকাশে উড়াল দিলেন, আর কেউ তাকে ধরতে পারলো না।– বাচ্চু হলেন এক দূরদেশী নক্ষত্র। আজও তার ভক্তরা নক্ষত্রজ্বলা রাতে আকাশে তাকিয়ে হয়তো তাকেই খুঁজে ফেরেন।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে ভিড় জমল স্কয়ার হাসপাতালের গেইটে। কেউ কেউ ভেবেছিল গুজব। আইয়ুব বাচ্চু কীভাবে মারা যায়! বাংলা গানে আরও কত কিছু দেয়া বাকি তার। না গুজব না সত্যি সত্যিই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আকাশে উড়াল দিয়েছেন বাংলাদেশের গীটার কিংবদন্তী। নকিব খান, পার্থ বড়ুয়া, সামিনা চৌধুরীসহ দেশের সঙ্গিতাঙ্গন থেকে শুরু করে সমস্ত অঙ্গনের মানুষ এসে জড়ো হতে লাগলো স্কয়ার হাসপাতালের সামনে।
বাংলাদেশের আরেক ব্যান্ড কিংবদন্তী নগরবাউল জেমস। যিনি কিনা আইয়ুব বাচ্চুর প্রায় সমসাময়িক। গেয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। জেমস তখন বরগুনায় কনসার্টে। দুপুরে ঘোষণা দিলেন প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুকে উৎসর্গ করা হবে তার সেদিনের কনসার্টটি। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দেখলো এক অবাক করা দৃশ্য। জেমস এমন এক চরিত্র যার সাথে হাসি কিংবা কান্না কোনটাই যায় না। প্রানবন্ত হাসি কিংবা হাউমাউ কান্নার জেমসকে ১৮ অক্টোবর ২০১৮ এর আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। জেমস কাঁদলেন, আইয়ুব বাচ্চুর জন্য হাউমাউ করে কাঁদলেন। কাঁদল বাংলাদেশ।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শহরের এক বনেদী হাজী পরিবারে জন্ম রবিনের। সঙ্গীত চর্চার জন্য খুব একটা অনুকূল পরিবেশ যে তিনি পেয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। সেই ছোটবেলা থেকেই সংসারে থেকেও বোহেমিয়ান রবিন। বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য সংসারের কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারছিল না তাকে।
পরিবারের সমবয়সী অন্যরা খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিন্তু রবিনের মন বলে অন্য কথা। তার মনে বাজে যেন অন্য সুর। নয়টা-পাঁচটা চাকরি করার পেছনে ছোটার জন্য যেন জন্ম হয়নি রবিনের। অন্যকিছু যেন অপেক্ষা করছে তার জন্যে। কিন্তু এতো সহজ ছিল না সেই পথ চলা। জোয়ারের বিপরীতে দ্বার টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহস এবং সামর্থ্য সকলের থাকে না। কিন্তু রবিন থেমে থাকার পাত্র নয়। তাকে যে জীবনের দুর্গম পথটিই বেছে নিতে হবে।
সংসারের সবার কাছে ছেলে গোল্লায় গেছে শুনতে শুনতে প্রায় অতিষ্ট রবিন। এমন সময় একদিন টিভিতে গানের একটি প্রোগ্রামে দেখলেন পপ সম্রাট আজম খানকে। অনেক আগে থেকেই আজম খানের ভক্ত রবিন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন পপ সম্রাটের গান। পাশে ঝাঁকড়া চুলে বোতাম খোলা শার্টে একজন গিটার বাজাচ্ছেন অসাধারণ দক্ষতায়। সেই প্রথম পরিচয় গিটারে দক্ষ হাতের খেলা। হবেই না বা কেন? বাজাচ্ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট ‘নয়ন মুন্সি’। এই লোকটি বাংলাদেশের গিটার জগতে এক অনন্য নাম।
সে সময়কার অনেক পরিচিত গান, যেমন- এই নীল মনিহার, মন শুধু মন ছুঁয়েছে, মেলায় যাই রে, আবার এলো যে সন্ধ্যা প্রভৃতি কালজয়ী গানের গিটারিস্ট নয়ন মুন্সী। তার এই অনবদ্য বাজনা শুনে রবিন ঠিক করে ফেললেন, জীবনে আর কিছু চান না, শুধু এমন অসাধারণভাবে গিটার বাজাতে চান। সেই থেকেই গিটারের পিছে ছোটা- আর তার পরের ইতিহাস তো ইতিহাস বইয়ের মতই উন্মুক্ত।
১৯৭৮ সালে ফিলিংসে যোগ দেন আইয়ুব বাচ্চু। ইংরেজি গানের কভার করার প্রবণতায় সেই সময় বেশি ছিল। প্রায় দু’বছরের মতো কাজ করার পর ১৯৮০ সালের দিকে পারস্পরিক মনোমালিন্যে ভেঙে যায় ফিলিংস। বেকার হয়ে পড়লেও কখনো মনোবল হারাননি তিনি। জানতেন একদিন ঠিকই তার গুণের কদর হবে। খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। ডাক পেয়ে গেলেন সোলসে যোগ দেয়ার জন্যে।
১৯৮৬ সালের দিকে আইয়ুব বাচ্চু ‘রক্তগোলাপ’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেন। এর ঠিক দুই বছর পর ১৯৮৮-১৯৮৯ এর দিকে ‘ময়না’নামে আরেকটি অ্যালবাম বের করেন যেটি অডিও জগতে খুব সাড়া ফেলে। সোলস ত্যাগ করে ১৯৯০ সালের ৫ই এপ্রিল নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করলেন আইয়ুব বাচ্চু, যার নাম রাখলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরবর্তীতে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’। সেই বছরই এল.আর.বি. তাদের যাত্রা শুরু করে একটি ডাবল এলবাম দিয়ে যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ডাবল এলবাম। এল.আর.বি’র প্রথম এই ডাবলসটি বের হয়েছিল মাধবী এবং হকার নামে।
১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়, বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, আমিও মানুষ। তিনি অনেক বাংলা ছবিতে প্লে ব্যাক করেছেন।
আজ এই কিংবদন্তির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। গুনীর প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করেছে এক অনন্য এক উদ্যগ। আইয়ুব বাচ্চুর ২৭২ টি গান সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম।
সেই তারা ভরা রাতে আমি পারি নি বোঝাতে তোমাকে আমার বুকের ব্যথা—- অগনিত ভক্তের কোলাহলে আপনি বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন থাকবে বাংলা ব্যান্ড।
ভয়েসটিভি/এএস