Home মুক্তমত আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

by Shohag Ferdaus
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস

শিক্ষা হচ্ছে সে শক্তি বা নিরন্তর প্রক্রিয়া পশুবৎ ব্যক্তির সুকুমার বৃত্তি, মুক্ত চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে জীবনযুদ্ধে উপযোগী,দক্ষ কর্মী, আত্মপ্রত্যয়ী, স্বাবলম্বী তথা মানবিক করে তোলে। শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নয়ন অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি থেকেই বিশ্বের উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হশ। ১৯৬৫ সালের ৮-১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইরানের তেহরানে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হয়। এই সম্মেলনে প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সভায় পৃথিবীর সকল নাগরিককে নিরক্ষরতামুক্ত করার লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে সারাবিশ্বে সাক্ষরতা দিবস হিসাবে পালন শুরু হয়।

এক সময় সাক্ষরতা বলতে নিজের নাম লিখতে পারাকেই বুঝাত। কিন্তু বর্তমানে শুধু নাম লিখতে পারলেই হয় না। সাক্ষরতার জন্য আরও তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। একজন ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট ছোট বাক্য পড়তে ও লিখতে পারা এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব করতে পারা।

সুদীর্ঘ দুইশত বছর বৃটিশদের শোষণ নিপীড়ন এবং ২৩ বছর পাকিস্তানের বৈষম্যের ফলে বাংলাদেশ শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ এর নির্বাচনে বলেছিলেন, শিক্ষার চেয়ে বড় কোনো বিনিয়োগ হতে পারে না। তিনি রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের ৪ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করার কথা বলেছিলেন।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় বাজেটেই শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সে সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংকে রিজার্ভ বলতে কিছুই ছিল না। গোডাউনে কোনো খাদ্য মজুত ছিল না, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলায় সারা বাংলাদেশ তখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল সেই চরম প্রতিকূল অবস্হার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সেদিন শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে এদেশে শিক্ষার ভীত রচনা করেছিলেন।

তিনি বিশ্বের উপযোগী একটি তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সার্বজনীন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সর্বজন গ্রহণযোগ্য শিক্ষক ডক্টর কুদরত ই খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেই শিক্ষানীতি আর আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন শুরু হয় ১৯৭২ সালে। শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই গতি ব্যাহত হয়। যার ফলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি।

আমাদের দেশে ১৯১৮ সালে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাক্ষরতা হার বৃদ্ধির প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৩৪ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নবাব আব্দুল লতিফ প্রমুখ কতিপয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৬০ সালে ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যুরো অব নন ফরমাল এডুকেশন’। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে ছয় থেকে দশ বছরের শিশুদের জন্য বিনামূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০১০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ফলে দেশ স্বাধীনতা লাভের সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর জাতি একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি পায়। বর্তমান সরকার সাক্ষরতাসহ শিক্ষার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই প্রদান, উপবৃত্তি, স্কুলে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় শিক্ষার হার বেড়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের সময় গত ১০ বছর সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৫.৩, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯.৮২ শতাংশে। গত ১০ বছরে বেড়ে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৭৪.৭০ শতাংশে। অর্থাৎ গত নয় বছরে বেড়েছে ১৪.৮৮ শতাংশ। তবে একথা সত্য বয়স্ক শিক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

শিক্ষার সঙ্গে সাক্ষরতা এবং সাক্ষরতার সঙ্গে একটি দেশের উন্নয়ণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি দেশকে এগিয়ে নিতে এবং দেশের জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যে দেশ যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ তত বেশি উন্নত। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক বিশ্বের উপযোগী দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের টেকসই যথাযথ উদ্যোগের পাশাপাশি সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা।

এবারের (২০২০ সালের) ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২০’ এর প্রতিপাদ্য ‘কোভিড-১৯ সংকট : সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল এবং শিক্ষাবিদদের ভূমিকা’।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে গড় সাক্ষরতার হার ৭৩.৯০ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ। গত ১১ বছরে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে। এ অবস্থায় এখনো প্রায় ২৫.৩০ শতাংশ মানুষ সাক্ষরবিহীন থাকা একবারেই বেমানান। তাছাড়া এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে অবশ্যই ১০০ ভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে হবে। অতিদ্রুত সকলকে সাক্ষরের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের পাশাপাশি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, সাধারণ সম্পাদক স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ এবং সচিব, শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like