Home জাতীয় আভিজাত্য আর জৌলুশের বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

আভিজাত্য আর জৌলুশের বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

by Shohag Ferdaus

মানবসভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে নিরন্তর গবেষণা আর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের মহাপীঠস্থান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। শান্ত টেমস নদীর কূল ঘেঁষে প্রাচীন নগরী অক্সফোর্ডের আভিজাত্য আর জৌলুশে ঘেরা এ যেন ইতিহাসের জনপদ। জ্ঞানতাপসদের স্মৃতি আর সৃষ্টিতে অনুপম। এর প্রতিটি ইট যেন বাঙ্ময় অজস্র ঘটনায়। প্রতিটি ইমারত বহন করে চলেছে সময়ের স্মৃতিচিহ্ন। পাঠাগারগুলোতে পায়ের ধুলা পড়েছে অসংখ্য মনীষীর। পথে পথে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের মণিকাঞ্চন। একাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড নগরীতে যাত্রা শুরু করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেই থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সুনাম-সুখ্যাতি অক্ষুন্ন রেখে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীব্যাপী।

মহাভারতে বর্ণিত স্থাপত্যশিল্পী ময় দানবের তৈরি অমরাবতীর চেয়েও সুন্দর প্রাসাদের নগরী অক্সফোর্ডে আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বছর আগে ৮০০ শতকে তৈরি হয়েছিল প্রথম চার্চ । আর সেই থেকেই অক্সফোর্ডে চালু হয় ধর্মভিত্তিক শিক্ষাবৃত্তি। এর পথ ধরেই একাদশ শতাব্দীতে যে উদ্দেশ্য নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার পুরোটাই আজ অর্জিত হয়েছে অক্ষরে অক্ষরে।

যশ আর খ্যাতির চূড়ায় যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বসে আছে, তার শুরুর ইতিহাসটি সঠিকভাবে কোথাও লেখা নেই! এ যেন এক চিরন্তন রহস্যেরই নামান্তর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু হবার লিখিত দলিল পাওয়া যায় ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। কিন্তু, নানান ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিত যে, ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দের আরো কিছুকাল পূর্বেই স্থাপিত হয়েছিল এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি।

ধর্মতত্ত্ব, আইন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও দর্শন বিভাগ নিয়ে শুরু হয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের কোন ভবন ছিল না, ভাড়া করা হল অথবা চার্চে ক্লাস নেওয়া হত। ১৩৫৫ সালে রাজার এক আদেশবলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড শহরে স্থান দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে কিন্তু পরবর্তীকালে রাজার ২য় পুত্রের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে যায়। ১৯ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। ১৮৮৭ সালে প্রথম মহিলা কলেজ লেডি মার্গারেট হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়টির আরও সংষ্কার করা হয়। বিজ্ঞানের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয় ও নতুন বিভাগ খোলা হয়।

শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৯টি কলেজ ও ৭টি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীরই কোনো না কোনো হল বা কলেজের সদস্য হতে হয়। শিক্ষার্থীদের অবকাশ যাপনের জন্য আছে মোট ৭০ একর পার্ক। রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় খেলার মাঠ, বোটানিক্যাল পার্ক, জেনেটিক পার্ক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর সবচেয়ে পুরাতন। ১৬৮৩ সালে এটি স্থাপিত হয়। তাছাড়া ‘ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’, ‘পিট রিভারস মিউজিয়াম’, ‘মিউজিয়াম অব দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’, ‘ক্রাইস্টচার্চ পিকচার গ্যালারি’, প্রতিটি জাদুঘরই ১৯ শতকে স্থাপিত হয়েছে।

অক্সফোর্ডের প্রধান গবেষণা গ্রন্থাগার বোডলেয়ান। এছাড়াও নতুন বোডলেয়ান, রেডক্লিফ ক্যামেরা, ক্লারেন্ডন বিল্ডিং, এই চারটি লাইব্রেরি হচ্ছে অক্সফোর্ডের প্রধান চারটি গ্রন্থাগার ভবন যেগুলো মাটির নীচ দিয়ে একটি টানেলের মাধ্যমে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে সংযুক্ত।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোডলিয়ান লাইব্রেরি ইউরোপের পুরোনো লাইব্রেরিগুলোর একটি। পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে কিং হেনরি অষ্টম যখন প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারক অধ্যাপক মার্টিন লুথারের লেখা বই পুড়িয়ে ফেলেন তার নির্বাহী আদেশে এর বছর পঞ্চাশেক পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বোডলিয়ান লাইব্রেরি তৈরি হয়েছিল সেই বই পোড়ানোর প্রতিবাদস্বরূপ।

সতেরো শতকের বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন রেডক্লিফ ক্যামেরা। একে হার্ট অব অক্সফোর্ডও বলা হয়। রেডক্লিফ ক্যামেরা মূলত এক বিশাল গ্রন্থাগার। ছয় লাখ বইসমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বসে গত ৩০০ বছরে গবেষণা করেছেন জগদ্বিখ্যাত গবেষকেরা। মজার ব্যাপার হলো, এই রেডক্লিফের চারপাশে ঘিরে রয়েছে পনেরো শতকের বিখ্যাত বোডলিয়ান লাইব্রেরি, চার্চ অব সেন্ট মেরি দ্য ভার্জিন, ব্রাসনজ কলেজ আর অল সোলস কলেজ। প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থাপনা যেন জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য–সংস্কৃতি আর স্থাপত্য দিয়ে ঘিরে ধরে আছে রেডক্লিফ ক্যামেরাকে। অথবা চারপাশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠা রেডক্লিফ ক্যামেরাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে শিক্ষার পথ ধরে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু জগৎ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা শিক্ষা লাভ করেছেন। ব্রিটেনে স্যার উইনস্টন চার্চিলের সময় থেকে এ পর্যন্ত যে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তার মধ্যে নয় জনই অক্সফোর্ডের গ্রাজুয়েট। এছাড়া অন্তত ৪৭ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, ২৮ জন বিদেশি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী, ১৮ জন কার্ডিনাল ও এক জন পোপ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন – জন ওয়েজলি, অস্কার ওয়াইল্ড, সেসিল রোডস, এডমান্ড হ্যালি, স্টিফেন হকিং, টিম বার্নার্স-লি, হিউ গ্রান্ট, রুপার্ট মার্ডক, মার্গারেট থ্যাচার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃষ্টি করার মাঝেও অনন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। একে আদর্শ মেনে নিয়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে কত শত বিশ্ববিদ্যালয় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, সেসবের মাঝে ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি মধ্যগগনের সূর্যের মতোই সর্বোচ্চ তেজে জ্বলজ্বল করছে।

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like