Home সারাদেশ হারানো স্বজনের জন্য হৃদয় নিংড়ানো আহাজারি

হারানো স্বজনের জন্য হৃদয় নিংড়ানো আহাজারি

by Mesbah Mukul

সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ অভিযান-১০-এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে গতকালও ছিল শোকের ছায়া। স্বজন হারানোর বেদনায় বরিশালজুড়ে গতকালও ছিল মানুষের হৃদয় কাতর করা আহাজারি।

গতকাল শনিবার কেউ ছুটেছেন বরগুনায় স্বজনের মরদেহ শনাক্ত করতে, কেউ বা দগ্ধ স্বজনকে একটু দেখতে হাসপাতালে। কেউ ছুটেছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কাছে নিখোঁজের নাম নিবন্ধন করাতে। আবার হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের কাতর চিৎকারে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। কেউ সুগন্ধার তীরে দাঁড়িয়ে আশায় ছিলেন নিখোঁজ স্বজনের ফিরে আসার। নানাভাবে স্বজন হারা মানুষ শনাক্ত না হওয়া স্বজনদের জানাজা, দাফন নিয়ে অশ্রুসজল সময় পার করেছেন।

এরই মধ্যে শুক্রবার রাত এবং গতকাল শনিবার মিলিয়ে ১৪ জনের লাশ শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর ২৩ জনকে গণকবরে দাফন করা হয়েছে। গতকাল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় আনার সময় পথে মারা যাওয়া শিশু তাইফাকে গতকালই দাফন করা হয়েছিল।

এ ঘটনায় গতকাল একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ৫১ জনের তালিকা তৈরি করেছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল সকালে লঞ্চটি পরিদর্শন করেন। ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা সুগন্ধা নদীতে দিনভর উদ্ধার অভিযান চালিয়েছেন। তবে নিখোঁজ কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি।

সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুনকাণ্ডে মারা যাওয়া ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করা না যাওয়ায় তাদের গণকবরে দাফন করা হয়েছে। গতকাল জানাজা শেষে দুপুর ২টার দিকে বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী সরকারি কবরস্থানে তাঁদের লাশ দাফন করা হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান, বরগুনা পৌর মেয়র কামরুল আহসান মহারাজ, প্যানেল মেয়র রাইসুল আলম রিপন প্রমুখ।

বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত ১৪ জনের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি ২৩ জনের পরিচয় না পাওয়ায় তাঁদের সরকারি কবরস্থানে গণকবরে দাফন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন : তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন : টিকটক হৃদয় গুলিবিদ্ধ

জানাজা শেষে স্বজনরা আরো সাত মরদেহ শনাক্ত করলে তাদের হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানী এলাকার শাহিদা (১৫), একই উপজেলার কালমেঘা গ্রামের তাবাচ্ছুম (৩), একই এলাকার রাজিব (১৩), বরগুনা সদরের ঢলুয়া গ্রামের মনোরা, অহনা, সদরের গৌরিচন্না ইউনিয়নের খাজুরতলার লামিয়া, সামিয়া, মাদারীপুরের রুমা (২৫) ও মাদারীপুরের মনোয়ারা (৭০)।

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা যায় বরগুনার বামনা উপজেলার লক্ষ্মীপুরা গ্রামের স্বপ্নীল হাওলাদার (১৪)। শনাক্তের পর গতকাল তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে গেলে ছোট ভাই প্রত্যয় হাওলাদারের গগনবিদারী হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। হাহাকার করে আট বছরের প্রত্যয় বারবার বলছিল, ‘ঠাকুর তুমি আমার দাদারে কই লইয়া গেলা! তোমরা আমার দাদারে এনে দ্যাও!’

জানা গেছে, একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে স্বপ্নীল, প্রত্যয় ও মা লক্ষ্মী রানী ওই লঞ্চে বামনায় যাচ্ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে স্বপ্নীল মারা যায়। স্বপ্নীলের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছলে এলাকাজুড়ে শুরু হয় শোকের মাতম। মা লক্ষ্মী রানী ছেলের মরদেহের পাশে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

স্বজনের খোঁজে

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। পাথরঘাটার মো. মোস্তফা তাঁর মেয়ে তাইবাকে খুঁজতে এসেছেন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে প্রধান ফটকে টানানো লঞ্চ দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া নিখোঁজ যাত্রীদের ছবি। ওই ছবিগুলোর মধ্যে তিনি খুঁজছিলেন মেয়েকে। মোস্তফার হাতে থাকা ছবি ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টানানো ছবির মধ্যে মিল খুঁজে পান স্বেচ্ছাসেবকরা। পরে তাইবার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। মোস্তফার মতো আরো অনেক স্বজন গতকাল শনিবার ভোরে নিখোঁজ লঞ্চ যাত্রীদের খোঁজে ভিড় করেন হাসপাতাল চত্বরে। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে ভোরের নীরবতা ভেঙে হাসপাতাল চত্বরের পরিবেশ হয়ে ওঠে ভারী।

এদিকে শুক্রবার রাত ১১টার দিকে লঞ্চের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মৃতদেহগুলো বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মর্গে রাখা হয়। শনাক্ত করার পর রাতেই পাঁচজনের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা হলো বরগুনা সদরের কেওড়াবুনিয়া গ্রামের তাইফা (১০), বেতাগী উপজেলার রিয়াজ (৩৫), পাথরঘাটার আবদুর রাজ্জাক, বরগুনা সদরের জাহানারা বেগম, বামনা উপজেলার স্বপ্নীল (১৪)। অন্য শনাক্তদের মধ্যে গতকাল সকালে দুজন এবং দাফনের আগে আরো সাতজনের মরদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ নিয়ে বরগুনায় মোট ১৪ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

৩৮ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেন মামলাটি করেন। ঝালকাঠি থানার ওসি খলিলুর রহমান জানান, মামলাটি তদন্তের জন্য থানার এসআই নজরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভয়েসটিভি/এমএম

You may also like