নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নড়াইলে ফসলি জমি দখল করে গড়ে উঠছে ইট ভাটা। জেলায় অর্ধ শতাধিক ইট ভাটায় কয়লার পরিবর্তে পুড়ছে কাঠ। এতে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে শত শত হেক্টর কৃষি জমি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী জেলায় মোট ৫৬টি ইট ভাটা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা গেছে, জেলায় মোট ইট ভাটার সংখ্যা ৭০টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ১০টিতে।
অনুমোদনের তোয়াক্কাই করে না অধিকাংশ ভাটা মালিকরা। লোকালয়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটায় বেপরোয়াভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। আর কৃষি জমির উপরি ভাগের উর্বর মাটি ব্যবহার হচ্ছে ইটের কাঁচামাল হিসেবে। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে গাছপালা, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে কৃষি জমি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকার ভেদে একটি ইট ভাটা গড়ে তুলতে কমপক্ষে পাঁচ একর জমির প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো ভাটা ৩০-৩৫ একর জমি নিয়েও তৈরি হয়। এক যুগ আগে জেলায় হাতে গোনা ২০-২৫টি ভাটা ছিলো। কিন্তু এখন তা বেড়ে প্রায় তিনগুণে। আর এসব ভাটা তৈরি করতে অন্তত ৪০০ একর ফসলি জমি ব্যবহৃত হয়েছে বলে দাবি কৃষকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাটার ম্যানেজার জানান, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০-৫০ লক্ষ ইট পোড়ানো হয়ে থাকে। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্যে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। যার যোগান আসে কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে ৭-৮ একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহৃত হয়।
সে হিসাবে ৭০টি ভাটায় প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ৩০০ একর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন ইট পোড়ানোর জন্যে গড়ে প্রতিটা ভাটায় ৩৫-৪০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। সে হিসেবে জেলার ভাটাগুলোতে প্রতিদিন দুই হাজার ৫০০ মণ কাঠ পোড়ে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক কাঠ ব্যবসায়ী জানান, সাধারণত আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে কাঠ কিনে ভাটায় পৌছে দেয়। গড়ে প্রতিটা গাছে ৪-৫ মণ কাঠ পাওয়া যায়। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন ইট ভাটায় আম, জাম, রেন্ট্রি, কদম, জামরুল, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেলসহ তিন শতাধিক ফলজ ও বনজ গাছ জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাটার মালিক জানান, বছরে পাঁচ মাস আমাদের ইট পোড়ানোর মৌসুম থাকে। পাঁচ মাসের প্রতিদিনই আমাদের ভাটাগুলোতে একই রকমের জ্বালানীর চাহিদা থাকে। সে হিসাবে মৌসুমে অন্তত ৫০ হাজারেরও বেশি গাছের কাঠ প্রয়োজন হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো নিষেধ। এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রথমবার সর্বোচ্চ ৫০হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ১-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও সাজার বিধান রাখা হয়েছে। তৃতীয়বার করলে নিবন্ধন বাতিল ও ভাটা বাজেয়াপ্ত করারও বিধান রাখা হয়েছে। তবে কাগজে কলমে আইনের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী কাজী হাফিজুর রহমান জানান, প্রতিটি ভাটায় অনবরত কাঠ বোঝাই যানবাহন প্রবেশ করে। ভাটাগুলোতে মজুদ রয়েছে হাজার হাজার মণ কাঠ। কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
কৃষিজমি এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ভাটায় স্বল্প উচ্চতার টিনের তৈরি চিমনি দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। এতে ফসলসহ পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
তিনি বলেন, প্রতি বছর এই সময় আসলে প্রশাসনের লোকজন কিছু কিছু ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করলেও তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। ইটাভাটার যে সব আইন রয়েছে সে আইন যথাযথ প্রয়োগ করে পরিবেশঘাতি এ সব কর্মকান্ড অচিরেই বন্ধ করা উচিত।
নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইটভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে কয়লা না পুড়িয়ে কেন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ ভাটার মালিকের নিকট থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দীপক কুমার বিশ্বাস বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে সেই জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। ৪-৫ বছর সেই জমি থেকে ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়। ফসলি জমির আশেপাশে ইট ভাটা থাকলেও ফসল উৎপাদন অনেক কমে যায়।
ফসলি জমির মাটি কেটে ইট ভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার কারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাব। একই সঙ্গে ফসলি জমির পাশে যেন ইটভাটার অনুমতি না দেন সে ব্যপারেও অনুরোধ জানাব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যশোর পরিবেশ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী নড়াইল জেলায় মোট ইট ভাটা রয়েছে ৪০টি। যার মধ্যে ১০টি ভাটার ছাড়পত্র আছে এবং বেশ কয়েকটি ভাটার ছাড়পত্র প্রক্রিয়াধীন।
চলতি মৌশুমে নড়াইলের অবৈধ ভাটাগুলোতে চার ধাপে অভিযান চালিয়ে ১৭টি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং আটটি ভাটার মালিককে জরিমানা করা হয়েছে। যে সকল ভাটাতে কয়লার বদলে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে মূলত তাদের ভাটাতে অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযান চলমান থাকবে।
জেলা প্রশাসক মোহম্মদ হাবিবুর রহমান জানান, নড়াইলে কিছু ইট ভাটা মালিক কয়লা ব্যবহার না করে কাঠ পোড়াচ্ছেন। পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ভাটায় নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে। আইন আমান্যকারী ভাটা মালিকদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
আরও পড়ুন : ঈশ্বরদীতে বাস চাপায় কাঠ ব্যবসায়ীর মৃত্যু
ভয়েস টিভি/এমএইচ