Home ভিডিও সংবাদ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জেলা চুয়াডাঙ্গা

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জেলা চুয়াডাঙ্গা

by Amir Shohel

ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা চুয়াডাঙ্গা। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। জেলার মোট আয়তন ১১৭৪.১০ বর্গ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চুয়াডাঙ্গা জেলার অবস্থান। এর উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে আলমডাঙ্গা উপজেলা, পূর্বে ঝিনাইদহ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ- পূর্বে জীবননগর উপজেলা ও পশ্চিমে দামুড়হুদা উপজেলা অবস্থিত।

চুয়াডাঙ্গা জেলা- চারটি উপজেলা ৪টি পৌরসভা ও ৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত। ২০১৯ সালের সবশেষ আদমশুমারি হিসাব মতে এ জেলার মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৩৯ হাজার ১৫ জন। এ জেলার ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গা, নবগঙ্গা, ভৈরব, চিত্রা ও কুমার নদী ।

এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির প্রায় বেশীরভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, পান, ভুট্টা ও বিভিন্ন সবজী চাষ মূলত এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল।

কথিত আছে, ১৭৪০ সালে চুঙ্গো মল্লিক নামে একজন তার পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতের নদীয়ার ইটেবাড়ি মহারাজপুর গ্রাম থেকে মাথাভাঙ্গা নদীপথে এসে প্রথম বসবাস শুরু করেন। চুয়াডাঙ্গার প্রথম বসতি গড়া চুঙ্গো মল্লিকের নামনুসারে নামকরণ করা হয় চুয়াডাঙ্গা জেলাকে। ১৭৯৭ সালের রেকর্ডেও নাম চুঙ্গোডাঙ্গা হিসেবে উল্লেখ হয়। পরে ফারসি থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করার সময় উচ্চারণের অশুদ্ধতার কারণে একটু পরিবর্তন করে চুয়াডাঙ্গা নামকরণ করা হয়।

দেশ স্বাধীনের পর প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর কার্যক্রমও শুরু হয় চুয়াডাঙ্গা জেলাতেই। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট অফিসের কার্যক্রম, প্রথম রেল স্টেশন ও রেড ক্রিসেন্টের যাত্রা শুরু হয় এ জেলা থেকেই। বাংলাদেশের একমাত্র দু’তলা রেল স্টেশনটিও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গাতে অবস্থিত। এছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম প্রণেতা এনএন সাহার জন্মগ্রহণ এই জেলাকে সমৃদ্ধ করেছে কয়েকগুণ। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল সাধক প্রয়াত খোদাবক্স শাহ’র জন্মস্থানও চুয়াডাঙ্গায়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গার ভূমিকা ছিল গৌরবজ্জ্বল। ঐতিহ্যবাহী এই জেলা ৬ দফা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনতায় রেখেছে স্মরণীয় অবদান। মুক্তিযুদ্ধকালীন বেশ কয়েকবার পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিপাগল সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ ও খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট জেলার দামুড়হুদা উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে ৮ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে ৮ শহীদের সম্মানার্থে জনগন্নাথপুর গ্রামে, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। যা বর্তমানে ৮ কবর হিসেবে পরিচিত।

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর কার্যক্রম শুরু হয় এ জেলাতেই। সে বছর ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে শপথ নেয়ার দিনও ধার্য হয়। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীরা চুয়াডাঙ্গাকে চিহ্নিত করে ফেলে। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি কৌশলগত কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে স্থান পরিবর্তন করে মেহেপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করেন। বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথ রুখতে মেহেরপুর জেলার সঙ্গে চুয়াডাঙ্গার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দুই জেলার সংযোগ মাথাভাঙ্গা সেতু বোমা হামলা করে উড়িয় দেয়া হয়।

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দার সেলুন নিজ উদ্যোগে স্মৃতিসৌধের পাশে গড়ে তুলেছেন একটি মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স। সেখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী ৮ শহীদের স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধটি কমপ্লেক্সটি দেখতে ভিড় জমায়। এছাড়া আলমডাঙ্গা উপজেলায় জিকে খালের পাশে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার স্থানটিতেও গড়ে তোলা হয়েছে বধ্যভূমি। এখানে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাতো।

দামুড়হুদা উপজেলা শহরে শিক্ষার মানকে আরো প্রসারিত করতে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখেছে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দামুড়হুদা নাটুদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্থানীয়রা বিদ্যালয়টিকে ‘হাজারদুয়ারী স্কুল’ নামেই চেনে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৬শ’র অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া, জেলায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯টি মহাবিদ্যালয়, ১৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪৪৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। মাদ্রাসা রয়েছে ৩৯টি, পলিটেকনিক ইনিষ্টিটিউট রয়েছে ৫টি, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে ১টি, টিটিসি ১টি ও পিটিআই রয়েছে ১টি। শিল্প সংস্কৃতিতেও পিছিয়ে নেই চুয়াডাঙ্গা। সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে প্রায় ৫০টির বেশি।

চুয়াডাঙ্গায় ঐতিহাসিক স্থান সমূহের মধ্যে রয়েছে ঠাকুরপুরের কয়েকশত বছরের প্রাচীন মসজিদ। কথিত আছে, ১৬৯৮ সালে একটি মিনার সমৃদ্ধ মসজিদটি রাতারাতি নির্মিত হয়। বর্তমানে মসজিদটি প্রায় ১১ বিঘার ওপর নির্মিত। স্থানীয়দের মতে, মসজিদটিতে এসে যেকোন সমস্যা সমাধান করতে মানত করলে তা পূরণ হয়। তাই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শতশত মানুষ মসজিদটিতে মানত করে থাকেন। প্রতি বছর বাংলা মাসের ১২ ফাল্গুন মসজিদ প্রাঙ্গণে ঔরশ হয়ে থাকে। ওই ঔরশ দেশ বিদেশের হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

ঐতিহাসিক স্থান সমূহের মধ্যে আরও রয়েছে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার কালুপোল গ্রামে রাজার ভিটা। কথিত আছে গন্ধর্ব রায়ের জমিদারি ছিলো গ্রামের চিত্রা নদীর তীরে। সেখানে তিনি বিশাল রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। তার রাজত্বকালে ওই এলাকায় ইসলামি দাওয়াত প্রচার করতে আসেন প্রখ্যাত সাধক হযরত খাঁন জাহান (রা.) সহচর ও অনুসারি খাজা মালেক উল গাউস। সে সময় ইসলাম প্রচার বন্ধ করা নিয়ে অত্যাচারি রাজা গন্ধর্ব রায়ের সাথে খাজা মালেক উল গাউসের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে রাজা গন্ধর্ব রায় নিহত হয়। যদিও ইতিহাসে রাজা গন্ধর্ব রায় সম্পর্কে কোন সুষ্পষ্ট তথ্য নেই। তবে, ২০১৬ সালে প্রত্নতাত্তিক জরিপ ও অনুসন্ধানে সুলতানি আমলের ওই রাজত্বের অস্তিত্ব মেলে। পরে ২০১৭ সালে প্রত্নতাত্তিক বিভাগের খনন কাজ শুরু হলে সুলতানি আমলের রাজা গন্ধর্ব রায়ের রাজভিটার স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বাংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়। বর্তমানে স্থানটিতে একটি জাদুঘর নির্মানাধীন রয়েছে।

এছাড়া ঐতিহাসিক স্থান সমুহের মধ্যে সদর উপজেলার সরিষাডাঙ্গা গ্রামের বিষু শাহ এর মাজার, গড়াইটুপির হযরত খাজা মালিক উল গাউজ এর মাজার, বেগমপুরে জমিদার শয়েরাম রায়ের কাচারীঘর ও জমিদারবাড়ি, নেহালপুর হযরত কিতাব আলী শাহ এর মাজার অন্যতম।

দামুড়হুদা উপজেলা কার্পাসডাঙ্গা গ্রামে ভৈরব নদীর পাশেই অবস্থিত জাতীয় কবি নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত আটচালা ঘর। বাড়িটির মালিক ছিলেন শ্রী হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস। তিনি তৎকালীন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং স্বদেশী আন্দোলন ও কংগ্রেসের নেতা। কলকাতা প্রবাসী মহিম সরকারের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে এখানে সপরিবারে আসেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস তার আটচালা ঘরে কবি নজরুল ইসলামের থাকার সু-ব্যবস্থা করেন। প্রথমবার সফরে কবি ঘরটিতে অবস্থান করেছিলেন দু’মাস। কালজয়ী কিছু ছড়া, কবিতা ও উপন্যাস, কবি এখানেই রচনা করেছিলেন। পরে কবি বহুবার এখানে এসেছিলেন বলে জানা যায়। এখানে সংরক্ষতি আছে নজরুলের ব্যবহৃত খাট ও আলমারি। প্রতি বছর নজরুলকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের মামা বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার কাশিপুর গ্রামে। যা কাশিপুর জমিদারী বাড়ি নামে পরিচিত। জমিদার বিনয় কুমার ছিলেন কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের মামা। এই মামা বাড়িতেই বসে তিনি রচনা করেন কালজয়ী ছোট গল্প “মহেশ”। এছাড়াও আছে আন্দুলবাড়ীয়া গ্রামে খাজা পারেশ পীরের দরগা, ধোপাখালি ২০০ বছরের পুরাতন মসজিদ ও ধোপাখালি মুক্তিযোদ্ধা করবস্থান এবং রাখাল শাহের মাজার।

ঐতিহ্যবাহী জেলা চুয়াডাঙ্গাতে ভ্রমণের জন্যও রয়েছে সরকারি তত্ত্বাবধানে ডিসি ইকো পার্ক। আছে দেশের দীর্ঘ তালসারি বাগান। শিশুদের জন্যও রয়েছে শিশু পার্ক, পুলিশ পার্কসহ বেশ কয়েকটি পার্ক।

দেশের সর্ববৃহৎ চিনিকল কেরু এন্ড কোম্পানি চুয়াডাঙ্গাতে স্থাপিত হয় ১৯৩৮ সালে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন।

ভারত বাংলাদেশে সড়ক পথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা স্থলবন্দরই ব্যবহার হয়ে থাকে। সপ্তাহের প্রতিদিনই এ স্থলপথের মাধ্যমে যাত্রীরা ভারত বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে পারেন। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে একমাত্র রেলপথটিও চুয়াডাঙ্গার দর্শনার ওপর দিয়েই গেছে।

চুয়াডাঙ্গার ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে গাফ্ফারের জাদুকরি চা। চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে হাতিকাটা এলাকায় বসে চায়ের হাট নামক গাফ্ফারের চা স্টলটি। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে ২০ রকম চা বিক্রি। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয়, আশপাশের জেলা থেকে মানুষ গাফ্ফারের চা পান করতে আসেন।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like