Home ধর্ম ইসলামে মুগ্ধ কয়েকজন রুশ কবি ও সাহিত্যিক

ইসলামে মুগ্ধ কয়েকজন রুশ কবি ও সাহিত্যিক

by Amir Shohel

এক বৈপ্লবিক সত্তা নিয়ে পৃথিবীতে ইসলামের আগমন। জন্মলগ্ন থেকে ইসলাম মানবসভ্যতাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে আসছে। ভাষা ও সাহিত্যও ইসলামের প্রভাবমুক্ত নয়। পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলামের আগমন হয়েছে, সে অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর ইসলামের প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে খুব অল্প দিনেই। আরব বণিক, ইসলাম প্রচারক ও মুসলিম বিজেতাদের মাধ্যমে রুশ ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে ইসলামের পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে রুশ কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও দার্শনিকরা ইসলামে মুগ্ধ হন এবং তাঁদের রচনায় ইসলামের প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ক্রমেই।

রুশ পর্যটকদের চোখে মুসলিম বিশ্ব

১৫ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার ব্যবসায়ী, পর্যটক ও দূতরা ইসলাম সম্পর্কে তাঁদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৫ শতকে প্রথম রুশ ব্যবসায়ী হিসেবে আফেনসি নিকিতিন ভারত, পারস্য, ইথিওপিয়া ও আরববিশ্ব ভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর বই ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার থ্রু দ্য থ্রি সিজ’-এ মুসলিমদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। অবশ্য তখনো এই বিষয়টি মীমাংসিত ছিল না যে, খ্রিস্টানদের অন্য ধর্ম সম্পর্কে মুগ্ধ হওয়া উচিত কি না। তিনি তাঁর বইয়ে বর্ণনা দিয়েছেন ভারতে খান জুননার তাঁকে ইসলাম গ্রহণে রাজি করাতে কিভাবে চেষ্টা করেছেন এবং তাঁকে পুরস্কার হিসেবে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার অঙ্গীকার করেছেন আর কিভাবে তিনি মুসলিমদের সঙ্গে রোজা রেখেছেন, তাও বলেছেন। যদিও তাঁর মধ্যে দ্বিধা ছিল যে বিষয়টি তাঁর নিজ ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না। ব্যবসায়ী ফিডোত কতোভ তাঁর বই ‘অ্যাডভেঞ্চার ইন পার্সিয়া’তে কিছু ইসলামী উৎসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার জন্য তিনি এই বই লেখেননি।

কবি পাভেল ক্যাটেনিনের ইসলাম অনুরাগ

রুশ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে পুরোপুরি শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রথম ইসলামের উল্লেখ করেন কবি ডেরজাভিন গ্যাভরিল রোমানোভিচ (১৭৪৩-১৮১৬)। তিনি মুসলিম অধ্যুষিত কাজান শহরে শৈশব কাটিয়েছেন। তিনি মাতৃভূমির স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘এমনকি ধোঁয়াও মিষ্টি ও চমৎকার হয়, যখন তা মাতৃভূমি থেকে আসে।’ অন্য কবিরা মুসলিম ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার মিলগুলো তুলে ধরেছেন। খ্যাতিমান কবি পাভেল ক্যাটেনিন (১৭৯২-১৮৫৩) ‘পিজন নেস্ট’ (কবুতরের বাসা) কবিতায় ইসলাম আবির্ভাবের উচ্চতর প্রশংসা করেছেন এবং আরব ভূমিতে ইসলামের প্রসার মানুষের জন্য কল্যাণকর বলে মন্তব্য করেছেন। ইসলামের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল কবি ও লেখক আলেকজান্ডার গ্রিবিওডভ (১৭৯৫-১৮২৯), পাইওটর ভাইজেমস্কি (১৭৯২-১৮৭৮), মুরায়েভ (১৭৯৪-১৮৬৬) প্রমুখের।

ইসলামে মুগ্ধ ছিলেন আলেকজান্ডার পুশকিন

ইসলামী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কালজয়ী রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭)। তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘কোরআনের সৌন্দর্যে আমি প্রশান্তি খুঁজে পাই।’ দক্ষিণ রাশিয়ার মুসলিমদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়া তুলে ধরেছেন ‘দ্য বখছিসারইস ফাউন্টেন’ ও ‘দ্য ককেশিয়ান প্রিজনার’ কবিতায়। ‘টেসিট’ কবিতায় তিনি বলেছেন, চেচেন রক্তে প্রতিশোধস্পৃহা ও তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো ইসলামী উপাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৮২৪ সালে পুশকিন ‘দ্য রিফ্লেকশনস অব দ্য কোরআন’ কবিতাটি লেখেন, যা তাঁর সৃজনশীলতায় ইসলামের প্রভাব স্পষ্ট করে। বিশেষত কোরআনের দার্শনিক ও নৈতিক শিক্ষাগুলো পুশকিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি লিখেছেন, ‘কোরআনের কিছু নৈতিক নীতিমালা খুবই প্রত্যয়ী ও কাব্যিক।’ ভলতেয়ারের সঙ্গে এক বিতর্কে পুশকিন লিখেছেন, ‘জান্নাত অসহায় মানুষের রক্ত প্রত্যাশা করে না, তার প্রত্যাশা ভালোবাসা ও বিশ্বাস।’ ফিওডর দস্তয়েভস্কি বলতেন, ‘প্রাচ্য সভ্যতার প্রকৃত মর্ম বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল পুশকিনের।’

‘দ্য রিফ্লেকশন অব দ্য কোরআন’-এর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে দস্তয়েভস্কি লেখেন, ‘এখানে কি আমরা একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখতে পাই না? কোরআন, তরবারি ও একটি দৃঢ় বিশ্বাসের শক্তি ও মহিমা দেখতে পাই না?’ এর দুই বছর পর পুশকিন একজন কবির জন্ম বিবরণী দিয়ে ‘প্ররোক’ (প্রেরিত পুরুষ) কবিতা লেখেন। তিনি লিখেছেন, ‘আল্লাহ তাঁকে সব কিছু দেখার চোখ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কবি ছিলেন না। আল্লাহ তাঁকে সব কিছু শোনার কান দিয়েছিলেন, তবু তিনি কবি ছিলেন না। আল্লাহ তাঁর হৃিপণ্ড পুনঃস্থাপন করেছিলেন, তখনো তিনি মরুভূমিতে মৃতের মতো ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে আল্লাহকে বোঝার ক্ষমতা দিলেন, কেবল তারপরই তিনি একজন কবি হলেন।’

রুশ লেখক ও দার্শনিকদের মূল্যায়নে ইসলামী সংস্কৃতি

বেস্টুজেভ মারলিনস্কি (১৭৯৭-১৮৩৭) ও পোলেয়াজেভ (১৮০৫-১৮৩৮)-এর ‘আমালাক বেগ’, হারেম, সুলতান ইত্যাদি রচনায় মুসলিম জীবনযাত্রার চিত্র উঠে এসেছে। প্রাচ্যের ইসলামী জীবনযাত্রার অনিন্দ্য সৌন্দর্য কবি মিখাইল লেরমন্তভকে (১৮১৪-১৮৪১) অনুপ্রাণিত করেছিল। স্রষ্টা কর্তৃক মানুষ ও সৃষ্টিজগতের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে আলেক্সি নিকোলভিচ তলস্তয় (১৮৮২-১৯৪৫)-এর ‘ক্রিমিয়া নোটস’-এ। নিকোলাই নেগ্রাসোভ তাঁর ‘তার্কিশ লেডি’ বইয়ে প্রাচ্যের সৌন্দর্য (মুসলিম জীবনের) তুলে ধরে একটি অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। নিকোলাই গোগল (১৮০৯-১৮৫২) ‘ফুল অব ফ্লাওয়ারস’ প্রবন্ধে ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের এবং ‘আল মামুন’ প্রবন্ধে আব্বাসীয় খলিফা মামুনের উচ্চ প্রশংসা করেছেন।

রুশ দার্শনিক ভ্লাদিমির সোলোভিয়েভ (১৮৫৩-১৯০০) বিশ্ব সভ্যতার উন্নয়নে মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলামের ভূমিকার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে ইসলামের অভ্যুত্থান ও বিকাশ ঘটেছে কোরআনের ‘আধ্যাত্মিক পুষ্টি’র কারণে, মানবজাতি যার মুখাপেক্ষী ছিল।’

লেখক লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) ইসলামী সংস্কৃতি ও মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর দীর্ঘ অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। তিনিও তাঁর রচনায় কোরআন ও ইসলামী সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এমনকি সমকালীন মুসলিম মনীষী ও বিদগ্ধ আলেম মুহাম্মদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫)-এর সঙ্গে তাঁর পত্রালাপও হয়। তাঁর উপন্যাস ‘হাজি মুরাদ’-এ ককেশাস পর্বতমালার বহু মুসলিম চরিত্র স্থান পেয়েছে।

তথ্যঋণ : মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রভাষক ড. ভিক্টর এ. পোগাদায়েভের ‘ফিফটিন সেঞ্চুরি রাশিয়ানস অ্যাডমিয়ার্ড ইসলাম’ প্রবন্ধ অবলম্বনে

You may also like