Home বিশ্ব উইঘুর মুসলিম নির্যাতন বন্ধে ট্রাম্পের নতুন আইনের নেপথ্যে!

উইঘুর মুসলিম নির্যাতন বন্ধে ট্রাম্পের নতুন আইনের নেপথ্যে!

by Newsroom

উইঘুর মুসলিম নির্যাতন বন্ধে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গেলো মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উইঘুর হিউম্যান রাইটস পলিসি অ্যাক্ট অব ২০২০ (ইউএইচআরপিএ) নামের একটি বিলে সই করেছেন যা এখন আইনে পরিণত হয়েছে। ওই আইনই তাঁকে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিম নির্যাতন বন্ধে চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

এ আইনে উইঘুরদের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য চীন সরকারের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং ‘ভোকেশনাল এডুকেশন’ নামের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে চীন কর্তৃপক্ষ উইঘুরদের মানবাধিকার যেভাবে কেড়ে নিচ্ছে, তা বন্ধ করতে বলা হয়েছে।

‘ভোকেশনাল এডুকেশন’ কার্যক্রমের নামে চীন উইঘুর তরুণ-তরুণীদের একটি জেলখানার মতো জায়গায় অবরুদ্ধ করে রাখে। তাদেরকে  পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয় না। তাদের ওপর নির্যাতন করা হয় এবং ধর্মীয় উপাসনা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করা হয়।

এ আইনের বিষয়বস্তু দেখলে সাদা চোখে মনে হবে উইঘুরদের পাশে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার বৈশ্বিক নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।

বহু দেশের গবেষকেরা এ বিষয়ে একমত যে উইঘুর মুসলমানদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাঁদের কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাঁদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। উইঘুরদের দুটো গ্রুপ আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চেয়ে মামলাও করেছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক  একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে মুসলমানদের তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে দূরে রাখতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে এসব করা হয়ে থাকে। তবে চীনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে যাতে উগ্রপন্থী ধ্যানধারণা তৈরি না হয়, সে জন্য তাঁদের বিশেষ ‘প্রশিক্ষণের’ অধীনে রাখা হয়ে থাকে। তাঁদের প্রকৃত ‘চীনা নাগরিক’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই বিশেষ শিক্ষা–দীক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।’

উইঘুরদের এ করুণ অবস্থার কথা পশ্চিমা দেশগুলোকে কখনোই খুব একটা নাড়া দেয়নি। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের মুসলমানরা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এ দেশগুলোর সরকার চীনের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। উইঘুরদের সঙ্গে নিবর্তনমূলক আচরণের বিষয়ে ইন্দোনেশিয়া সরকার বলেছে তারা ‘চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ নাক গলাবে না। ১৯৫০–এর দশকে উইঘুরদের তুরস্ক সরকার আশ্রয় দিত। কিন্তু এখন তুরস্কের পুলিশ জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে আসা উইঘুরদের ধরে ধরে আটককেন্দ্রে রাখছে এবং তাদের চীনের হাতে প্রত্যর্পণ করছে বলেও খবর আসছে।

ঠিক এমন এক সময় ট্রাম্প সরকারের মতো বর্ণবাদী সরকার চীনের বিরুদ্ধে ও উইঘুরদের পক্ষে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা আসলেই অবাক করার মতো। যুক্তরাষ্ট্রে যখন বর্ণবাদ নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তখন ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ অবাক করার মতোই বিষয়।

এদিকে ট্রাম্পের এ উদ্যোগকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে শুধু ভণ্ডামির মধ্য দিয়ে মুসলমানদের খুশি করার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য ট্রাম্প ভালো করেই জানেন, আমেরিকান মুসলমানদের মধ্যে তিনি ভীষণ অজনপ্রিয়। তিনি যে তাঁদের বিষয়ে নানা সময়ে বর্ণবাদী বক্তব্য দিয়েছেন এবং তাতে তাঁরা যে নাখোশ হয়েছেন, তা তিনি জানেন। ট্রাম্প ইউএইচআরপিএতে যেদিন সই করেন, ঠিক সেদিনই জন বোল্টনের নতুন বই বাজারে আসে। বোল্টন তাঁর বইয়ে বলেছেন, ট্রাম্প শুধু উইঘুরদের মানবাধিকারের বিরুদ্ধেই নন, উইঘুরদের জন্য আটককেন্দ্র বানানোর জন্য তিনি নিজে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে রীতিমতো উৎসাহ দিয়ে এসেছেন।

ট্রাম্প নিজেই ২০১৭ সালে মুসলমানদের জন্য আমেরিকায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীদের জন্য আমেরিকায় আসা বা থাকা কঠিন করে তুলেছেন তিনি।

অনেকে মনে করেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর থেকেই ট্রাম্প চীনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে তিনি চীনের বড় বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছেন। মূলত চীনের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার একটি আইনগত ভিত্তি দাঁড় করানোর জন্যই তিনি এ আইন পাস করলেন। অর্থাৎ উইঘুর মুসলিমদের অধিকারহীনতা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। তাঁর মূল লক্ষ্য উইঘুর ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে চীনকে কোণঠাসা করা।

ট্রাম্প যে আইনকে সমর্থন করেছেন, সে আইনে চীন সরকারকে বিদেশে থাকা উইঘুর মুসলিমদের তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিতে বলেছে। কিন্তু ট্রাম্প নিজেই আমেরিকায় থাকা বহু মুসলিমকে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। ট্রাম্প ২০১৭ সালে যে নির্বাহী আদেশ দিয়ে ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেই আদেশকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার ঘটনা টেনেছিলেন। অথচ এসব দেশ এ হামলার জন্য দায়ী ছিল না।

এসব কারণে ট্রাম্পের একই সঙ্গে উইঘুরদের প্রতি আকস্মিক সমবেদনা এবং তাঁর মুসলিমবিদ্বেষ তবে সবার কাছেই রহস্যজনক ঠেকছে। তার এ মুসলিমবিদ্বেষ কেবল সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা যুক্ত নয়।   সাধারণ মুসলমানরা অবশ্য ভালো করেই জানে, তাদের সম্পর্কে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ধারণা কেমন। তিনি অবলীলায় একাধিকবার মেক্সিকানদের ধর্ষক ও মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেছেন। এ কারণে তাঁর এ উদ্যোগকে খুব আশাব্যঞ্জক কিছু বলে মুসলমানরা মনে করছে না। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন এই মার্কিন সরকারের ভাষ্যের প্রতি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আস্থা নেই।

আগামী নির্বাচনে যদি ট্রাম্পের জায়গায় নতুন প্রেসিডেন্ট স্থলাভিষিক্ত হন, তাহলে সেই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে এ আস্থা ফিরিয়ে আনা। যেহেতু আইনটি বলবৎ থাকবে এবং এর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই চীনের উইঘুরদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকছে, সেহেতু আইনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সরকার কাজে লাগাতে পারবে।

(লিখেছেন- অ্যান মারি স্লটার ও ওয়ারদাহ খালিদ। ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট)
অ্যান মারি স্লটার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক প্রধান এবং
ওয়ারদাহ খালিদ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রুম্যান ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রজেক্টের একজন সিকিউরিটি ফেলো

You may also like