Home ভিডিও সংবাদ ঐতিহ্য আর সংগ্রামের উর্বরভূমি রংপুর

ঐতিহ্য আর সংগ্রামের উর্বরভূমি রংপুর

by Amir Shohel
রংপুর

উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন জেলা রংপুর। যে জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, যমুনেশ্বরী। এ যেন ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের উর্বরভূমি। এই জনপদের যেমন রয়েছে হাজারো গান ও লোককাহিনী, তেমনি রয়েছে গৌবরউজ্জ্বল ইতিহাস ও প্রাচীন নিদর্শন।

এরমধ্যে অন্যতম তাজহাট জমিদারবাড়ি বা তাজহাট রাজবাড়ি। রংপুর শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটার দূরে এই ঐতিহাসিক প্রাসাদটি এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট সবুজ গাছপালা, সুশোভিত ফুলের বাগান, ডালে ডালে পাখির কলকাকলি আর পুকুরের স্বচ্ছজল মুগ্ধ করে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মান্নান লাল রায় রঙ্গপুরের মাহিগঞ্জে এসেছিলেন হীরা, জহরত ও স্বর্ণ ব্যবসার জন্য। প্রথমে তিনি নামী দামী হীরা, মানিক জহরতখচিত তাজ বা টুপির ব্যবসা করতেন । পরে এলাকাটির নাম হয়ে যায় তাজহাট। আর জমিদারবাড়ীটির নাম হয় তাজহাট জমিদার বাড়ি।

তাজহাটের প্রথম জমিদার ছিলেন গোবিন্দ লালের ছেলে গোপাল লাল। যিনি স্থানীয়ভাবে তাজহাট জমিদার নামেই পরিচিত। তবে এ বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মান্নান লাল রায়। তিনি ভারতের পাঞ্চাব থেতে রংপুরের মাহিগঞ্জে স্বর্ণ ব্যবসার জন্য এসেছিলেন। আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় প্রাসাদটি তৈরি করেন।

১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি ব্যবহার করা হয় রংপুর হাইকোর্ট হিসেবে। এটি সুপ্রিম কোর্টের একটি শাখাও ছিলো। তৎকালিন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে হাইকোর্ট বিভাগের আঞ্চলিক শাখা স্থাপন করেছিলেন। ১৯৯১ সালে এই কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে প্রত্নত্ত্ববিভাগ প্রাসাদটিকে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে। পরে ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে স্থানান্তর করে এই প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসা হয়।

তাজহাট মোড় থেকে একটু পুর্বে গেলেই দেখা মিলবে জমিদার বাড়িটির। এটি প্রায় ২১০ ফুট প্রশস্ত ও চার তলার সমান উঁচু। এর গঠনশৈলীতে রয়েছে মুঘল স্থাপত্যের প্রতিচ্ছবি। মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ, সেখানে আছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম।

আরো আছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি। এর মধ্যে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় লেখা কুরআনসহ, মহাভারত ও রামায়ণের পান্ডুলিপি। পেছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটা কালো পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি।

রাজবাড়িটি দেশের অন্য সব রাজবাড়ি থেকে আলাদা। এখানে ৩১ টি সিড়ির প্রতিটিই ইতালীয় মার্বেল পাথরে তৈরি। সিঁড়ি থেকে উঠে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটা একই পাথরে তৈরি। রাজবাড়ির পেছনে আছে গুপ্ত সিঁড়ি। জনশ্রুতি রয়েছে এই গুপ্ত সিঁড়ি একটি সুড়ংগের সাথে যুক্ত যা সরাসরি ঘাঘট নদীতে যুক্ত।

কালের বিবর্তনে প্রাসাদের ফোয়ারাটির শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও সবুজাভ নকশা কিছুটা মলিন হলেও এখনো জৌলুষ বোঝা যায়। কথিত আছে জমিদারের স্ত্রীর জন্যেই বিশেষ করে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

তাজহাট জমিদারবাড়ির প্রথম তলার ছাদ নির্মাণে বড় বড় লোহার বিম ও ফালি ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়তলায় ওঠার জন্য তিনটি পথের মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত মাঝের পথটি। সবকটি পথের প্রতিটি ধাপ এবং বারান্দাটি মসৃণ সাদা ও ছাই রংয়ের পাথরে মোড়ানো।

প্রধান ইমারতের উত্তর অংশের মাঝামাঝি ২য় তলায় ওঠানামার জন্য সুন্দর কাঠের তৈরি ২২টি ধাপের সিঁড়ি ও দক্ষিণের প্রাসাদে ২য় তলায় ওঠানামার জন্য লোহার নকশা করা ঝুলন্ত মজবুত সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়িগুলোর রেলিংয়ে আছে লোহার তৈরি ফুলগাছ।

সামনের প্রাসাদের ২য় তলায় ওঠানামার জন্য একটি বিশাল গ্যালারির মতো সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটি তিনটি স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তরে ১টি ধাপ, ২য় স্তরে ওঠার সময় একটু সমতলে নেমে আবার ১৪টি ধাপ পেরিয়ে একটি দর্শণীয় আয়তাকার প্লাটফরমে ওঠা যায়। এটি যা দ্বিতীয় তলার ছাদের সাথেও যুক্ত। এটাকে বলা হয় শেষ স্তর।

এই বিশাল সিঁড়িটির দৈর্ঘ ৬৬ফিট থেকে শুরু। ওপরের দিকে প্রশস্ত ৪৯ফিট। তবে ক্রমান্বয়ে এই পরিমাপ কমিয়ে ৩৩ফিট করা হয়। সিঁড়িটির ভূমি থেকে দ্বিতীয় ভবনের ছাদ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অংশ মসৃন সাদা- কালো পাথরে মোড়ানো। এখনও এটি পুরোপুরি অক্ষত রয়েছে।
বর্তমানে প্রাসাদটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই জাদুঘর দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছে দর্শনার্থীরা।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like