Home প্রবাসী কারাগার থেকে কারাগারে

কারাগার থেকে কারাগারে

by Newsroom

বেআইনিভাবে প্রবেশের অভিযোগে বাংলাদেশি যুবককে গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেয়া হয় পাপুয়া নিউগিনির এক কুখ্যাত কারাগারে। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস দ্বীপে পা রাখার দায়ে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে ঘুরছেন ৩০ বছর বয়সী ওই যুবক।

১৩ অক্টোবর মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এসবিএস নিউজের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশি হেলাল উদ্দিনের দীর্ঘ সংগ্রাম। যিনি হেলাল ‘স্পাইসি’  উদ্দিন নামে পরিচিত।

কারাগার থেকে কারাগারে ঘুরতে ঘুরতে পেয়েছেন প্রেমের সন্ধান, এরপর বিয়ে এবং হয়েছেন সন্তানের পিতাও। এখন তিনি আবারও কারাগারে। সাত বছরের লড়াইয়ে তিনি সাক্ষী হয়েছেন নির্মম হত্যাকাণ্ডের। দেশ ছেড়ে নৌকা করে অকূল সমুদ্র পাড়ি দিতে দেখেছেন বন্ধুদের লাশ।

শুরুতে বন্দী ছিলেন মানুস দ্বীপের কুখ্যাত কারাগারে। মুক্তি পেয়ে ঠাঁই হয় দেশটির মূল ভূখণ্ডের বোমানা কারাগারে। মাঝখানে তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে। প্রেমের টানে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে আবার ছুটে যান পাপুয়া নিউগিনিতে।

গত এপ্রিলে পাপুয়া নিউগিনির আদালত হেলালকে দ্রুত মুক্তি দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তাকে তিন বছরের জন্যে বসবাসের অনুমতি দেন। কিন্তু মুক্তির আনন্দ কপালে জোটেনি এ বাংলাদেশির। কারাগার থেকে ছাড়ার পাওয়ার মাত্র ১০ দিন পর আবারও বন্দী জীবনে ফিরে যেতে হয় তার। তিনি এসবিএসকে জানান, ‘আমার জীবন নিয়ে সিনেমা হওয়া উচিত।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি দেশ ছাড়েন। তিনি জানান, গ্রামে সরকারবিরোধী এক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। বিরোধী দলকে সমর্থন করায় তাকে জেলে যেতে হবে এমন শঙ্কা থেকে অবৈধভাবে দেশ ছাড়েন তিনি।

আরো পড়ুন: দেশের কারাগার গুলোতে ২৮৮৪ বন্দি মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু

এর আগে রাজধানী ঢাকায় তিনি বাবুর্চি পেশায় জড়িত ছিলেন। পরে মানুস দ্বীপের ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী অন্যান্য অভিবাসীদের জন্যে তিনি রান্না করার জন্যে তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘স্পাইসি’ শব্দটাও। পরবর্তীতে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেন খাবারের দোকান।

২০১৬ সাল পর্যন্ত মানুসের কুখ্যাত কারাগারে বন্দী ছিলেন হেলাল। ডিটেনশন সেন্টারটির বন্দীদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে অস্ট্রেলিয়া সরকার সেটি বন্ধ ঘোষণা করে। পাপুয়া নিউগিনিতে অবস্থিত হলেও অভিবাসী ডিটেনশন সেন্টারটি মূলত গড়ে তোলে অস্ট্রেলিয়া। পাপুয়া নিউগিনি আদালত ঘোষণা দেয় যে, অন্যায়ভাবে মানুসের কারা পরিবেশে দুই বছর ছয় মাস আটকে রাখা হয় হেলাল উদ্দিনকে।

মানুস থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ওই দ্বীপেই পরিচয় হয় তরুণী অ্যালিস মিখাইলের সঙ্গে। তার সঙ্গে প্রেম হয় হেলাল উদ্দিনের। ২০১৭ সালের মার্চে তারা বিয়ে করেন। হেলার বলেন,  মুক্তি পাওয়ার পর একটি চাইনিজ সুপারমার্কেটে আমার স্ত্রীকে পেয়ে যাই। আমি তার প্রেমে পড়ি, তাকে বিয়ে করি।

কিছুদিন পর তাদের কোলজুড়ে আসে ছেলে মোহাম্মদ আলী। এরপর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখেই জীবনযাপন করছিলেন হেলাল। টোরেনগাউ শহরে ছোট একটি খাবারের দোকান খুলে ভালোই চলছিল তার।

২০১৮ সালের মার্চে আবারও ভাগ্যের কাছে হার মানলেন হেলাল উদ্দিন। কর্তৃপক্ষ শরণার্থী হিসেবে তার বসবাসের অনুমতি বাতিল করে গ্রেফতার করে। পাপুয়া নিউগিনির অভিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী রিমবিঙ্ক পাতো জানান, দেশটিতে তার বসবাস অবৈধ। স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ না গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমন পরিস্থিতিতে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। হেলাল বলেন, তারা আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। কিন্তু আমার প্রেম আবার এখানে ফিরিয়ে এনেছে। দিন রাত স্ত্রী-পুত্রের জন্যে কাঁদতাম। সারাক্ষণ চিন্তা করতাম আমার ছেলে কীভাবে খাচ্ছে, কীভাবে খেলছে। কীভাবে তারা আছে শুধু এ চিন্তা করতাম।

বৈধভাবে পাপুয়া নিউগিনিতে ফিরে যেতে তিনি ভিসার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বাংলাদেশ থেকে নৌকায় চড়ে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়া হয়ে আবার পাপুয়া নিউগিনিতে পৌঁছান। এবারও ভিসা বা পাসপোর্ট কিছুই ছিল না তার।

তিনি বলেন, ছয় সপ্তাহের সেই নৌকা ভ্রমণে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্র সীমানার কাছে আমার তিন বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমার বেঁচে থাকা অলৌকিক।

মানুস দ্বীপের পশ্চিমে নেমে তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে মিলিত হন। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান তিনি। কিন্তু কয়েক মাস পর আবারও গ্রেফতার হন তিনি। ব্যবসার জন্যে বৈধ কাগজপত্র তুলতে গিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ আবারও ধরা পড়েন তিনি।

তিনি বলেন, আমি ভালো মানুষ। ভালোবাসার টানেই বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাপুয়া নিউগিনিতে এসেছি।

হেলাল বলেন, কোনো ধরনের চাকরি ও অর্থ ছাড়া ছেলেকে নিয়ে আমার স্ত্রী বেঁচে থাকার লড়াই করছে। আমাকে প্রয়োজন তাদের। এখন আমি কী করব। আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে চাই। আমাকে ছাড়া তারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা তার এই কেসটি সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের আইনি প্রচেষ্টার পর এ বাংলাদেশি যুবককে মুক্তির জন্য নির্দেশ দেন পাপুয়া নিউগিনির আদালত। সব মিলিয়ে দেশটিতে তিন বছর সাত মাস জেলে ছিলেন তিনি।

মুক্তি ও স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আপিল করে জিতলে আবারও তাকে ফিরে যেতে হয় কারাগারে। মাঝখানে মাত্র ১০ দিন তিনি কারাগারের বাইরে ছিলেন। এখন তিনি পাপুয়া নিউগিনির মূল ভূখণ্ডের বোমানা কারাগারে বন্দী।

হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জানি না, কখন আমি আমার পরিবারকে দেখব। আমার ছেলে আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। আমি তাকে বলেছি, আমি কারাগারে যাচ্ছি। এটি বলাটা কী কঠিন বোঝানো যাবে না। আমার জীবনে যা ঘটেছে, জানি না অন্য কোনো শরণার্থীর জীবনে এমনটি ঘটেছে কী না।’

দঅস্ট্রেলিয়া থেকে তাকে আইনি সহায়তা দেয়া ইয়ান রিনতুল বলেন, আমরা ন্যাশনাল কোর্টে জিতেছিলাম। তিনি মুক্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হওয়ায় আবার গ্রেফতার হন। তার কেসটি এখন সুপ্রিম কোর্টে আছে। এখনও শুনানির তারিখ হয়নি।

ভয়েস টিভি/এমএইচ

You may also like