Home ভিডিও সংবাদ কালের সাক্ষী রাম রাজার রাজবাড়ি

কালের সাক্ষী রাম রাজার রাজবাড়ি

by Amir Shohel

মাগুরা জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে মধুমতি-নবগঙ্গা নদী বিধৌত মহম্মদপুর উপজেলা। রাজা সীতারাম রায়ের তৎকালীন ভূষণা রাজ্যের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর। মোঘলদের বিরুদ্ধে রাজা সীতারামের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরত্বের ইতিহাস আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই এলাকাটিই বর্তমানে ফরিদপুর ও মাগুরা জেলা।

মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের একজন আমলা রাজা সীতারাম রায়ের নির্মিত অসংখ্য নান্দনিক কারুকার্য খচিত স্থাপনা রয়েছে। এসব প্রত্নস্থান যা স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ি নামে পরিচিত। সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে এখানে পত্তন হওয়া উন্নত এক জনপদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি আমলা থেকে জমিদার এবং পরে রাজা উপাধি লাভ করেন।

উপাধি লাভের পর রাজার মতোই রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন সীতারাম এবং সেনাবল বৃদ্ধি করে তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদারদের ভূ-সম্পত্তি দখল করেন। তিনি নবাব সরকারের রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে স্বাধীন, সার্বভৌম রাজার মতোই জমিদারিতে প্রত্যাবর্তন করেন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। জমিদারি সুরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে সীতারাম এ স্থানটিতে গড়ে তোলেন অসংখ্য দুর্ভেদ্য দুর্গ, কাঁচারিবাড়ি পরিখা পরিবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ, পূজার্চনার জন্য দেবালয়, জনহিতের জন্য খনন করেন বেশ কিছু বিশালাকার জলাশয়।

রাজা, রাজ্য, পাইক-পেয়াদা কিছুই নেই। নেই হাতিশালে হাতি, ঘোড়া শালে ঘোড়া। তবু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা। প্রত্নতাত্ত্বিক এসব স্থাপনা সময়মতো সংক্ষণের উদ্যেগ না নেয়ায় ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাজপ্রসাদের মূল্যবান জিনিসপত্রসহ টেরাকোটা খুলে বিক্রি করে দিয়েছে এক শ্রেণির অসাধু লোকজন। সীতারামের বিশাল সম্পত্তির বড় অংশ এখন অবৈধ দখলে।

সরকার সীতারামের স্থাপনাগুলো সংস্কার ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছে বলে জানা গেছে। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী নান্দনিক এ স্থাপনাগুলো দেখতে আসেন। এ স্থাপনাগুলো সংস্কার করা হলে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীরা।

জানা যায়, মুকুন্দরাম-সত্রাজিতের পতনের পর ভূষনা রাজ্যে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। মগ দস্যূদের অত্যাচারে রাজ্য হয়ে পড়ে জনশূণ্য। ঠিক ওই সময়েই আবির্ভাব ঘটে রাজা সীতারামের। মগ দস্যূ বিতারণে আর দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সীতারামের নির্মাণ করা দূর্গসহ নানান কীর্তির ধংস্তুপ ছড়িয়ে আছে ভূষনা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে এ রাজ্যের রাজধানী বর্তমান মাগুরার মহম্মদপুরে।

সীতারামের পিতা উদয় নারায়ণ দাস ছিলেন ভূষনা রাজ্যের ফৌজদারের অধীনে কর্মরত খাজনা আদায়কারী কর্মচারী। তার মাতা দয়াময়ী ঘোষ। পার্শ্ববর্তী গোপালপুর গ্রামে বসবাস করতেন তারা। ছেলেবেলায় পড়ালেখার পাশাপাশি সীতারামের প্রধান নেশা ছিল অস্ত্র শিক্ষা। তরুণ বয়সে এসে মগ দস্যুদের উদ্বেগের কারণ হয় সীতারাম।

সীতারাম সংস্কৃত, বাংলা, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তার হস্তরেখা খুব আকর্ষণীয় ছিল। তিনি অশ্বচালনা, তরোয়ালবাজি আর লাঠিখেলায় দক্ষতা অর্জন করেন কৈশোরেই।

সুবেবাংলার রাজধানী ঢাকায় বেশ আসা-যাওয়া ছিল তরুণ বীর সীতারামের। কুখ্যাত দস্যু বক্তার খাঁকে পরাজিত করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন তিনি। ফলে ছোটখাট দস্যুরা সীতারামের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এসব খবর শুনে খুশী হন তৎকালীন বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ।

তার সাফল্যে শায়েস্তা খাঁ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে নলদী পরগনার জায়গির দিয়ে সম্মানিত করেন। এই ১টি পরগনার কর্তৃত্ব থেকে ধীরে ধীরে আশপাশের ৪৪টি পরগনা নিজের আওতায় নিয়ে আসেন তিনি। নলদী পরগনার জায়গীরদার হওয়ার পর থেকেই সীতারাম শুরু করেন নিজের শক্তিশালী বাহিনী গড়ার কাজ।

শায়েস্তা খাঁর সুপারিশ আর মোঘল দরবারে গিয়ে সাক্ষাতের ফলে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সীতারামকে রাজা উপাধীতে ভূষিত করেন। তাকে সুন্দরবন পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গ এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। আর চারণ কবিরা সীতারামকে নিয়ে বাঁধেন গান। সেই গানগুলো ছিল এমন- ধণ্য রাজা সীতারাম, বাংলা বাহাদুর/ যার বলেতে চুরি-ডাকাতি হয়ে গেল দূর। বাঘ-মানুষে একই সাথে সুখে জল খায়/ রামীশ্যামী পুটলি বাঁধি গঙ্গাস্নানে যায়।

রাজা সীতারামের কোনও রাজধানী ছিল না। জনশ্রুতি আছে, রাজধানীর জন্য সীতারাম খুঁজে বের করেন খাল-বিল আর গাছপালা বেষ্টিত একটি এলাকা। যা ছিল তৎকালীন সিদ্ধ পুরুষ দরবেশ মহম্মদ খাঁর এলাকা। তার নামানুসারে ওই এলাকাটি পরে মহম্মদপুর হিসেবে পরিচিতি পায়। যা বর্তমানে মাগুরা জেলার একটি উপজেলা।

দরবেশ সাহেবের কাছ থেকে ওই স্থানটি চেয়ে নিয়ে গড়লেন বিশাল দূর্গ। যা ছিল দুই মাইল বিস্তৃত পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। রাজা দূর্গের চারপাশে ও ভেতরে খনন করলেন বেশ কয়েকটি দিঘি। এগুলোর মধ্যে উল্লেযোগ্য হলো- রামসাগর, সুখসাগর ও কৃষ্ণসাগর। দূর্গের প্রবেশদ্বারের সামনেই ছিল রামসাগর। এসব জলাশয় পেরিয়ে শত্রুপক্ষের দূর্গে প্রবেশ ছিল প্রায় অসম্ভব। সুখসাগর দিঘীর মাঝে ছিল একটি ছোট্ট দ্বীপ। যেখানে অবসর বিনোদন করতেন রাজা সীতারাম।

মহম্মদপুর উপজেলায় ভূষণার রাজা সীতারাম রায়ের রাজবাড়ি ও কাচারী বাড়িসহ অসংখ্য স্থাপনা সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে তার পুরনো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা সীতারাম রায়ের এ বাড়িটির দ্বিতল ভবন, দোলমঞ্চ, তার খননকৃত দীঘিগুলো রয়েছে। তবে প্রভাবশালীরা রাজার অনেক জমিই দখল করে নিয়েছে। যা হাত বদল হতে হতে একেবারেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজা সীতারামের ইতিহাস এক গৌরবউজ্জ্বল অধ্যায়।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like