Home ভিডিও সংবাদ গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার

by Amir Shohel

গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। উনিশ শতকে এই সাবংবাদিক ও তান্ত্রিক সাধক গ্রামবাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন। নাগরিক নবচেতনার প্রেরণায় দূর-মফস্বলেও রচনা করতে পেরেছিলেন জাগৃতির বাতাবরণ।

এই বহুমাত্রিক মানুষটি একাধারে ছিলেন সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র-পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, নারীকল্যাণকামী, দেশহিতৈষী, রায়ত-কৃষক-প্রজাপ্রেমী, সাধক ও ধর্মবেত্তা এবং নব্য-সাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। বিশেষ করে গ্রামীণ সাংবাদিকতার জনক হিসেবে তাঁর নাম আজও স্মরণীয়।

হরিনাথ মজুমদার সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। বাবা হলধরচন্দ্র মজুমদার, মায়ের নাম কমলীনি দেবী। বৃটিশ-ভারত অবিভক্ত বাংলায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুন্ডুপাড়ায় তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৩৩ সালের ২০ জুলাই। শৈশবেই বাবা-মাকে হারিয়ে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে বেড়ে ওঠেন হরিনাথ। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেন তিনি। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয়নি হরিনাথ মজুমদারের।

আরও পড়ুন- অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ ফকির লালন শাহ্

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার একাধারে বাউল সাধক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমৃত্যু বঙ্গদেশে শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন তিনি। কাঙাল হরিনাথ নিজে বেশি লেখাপড়া না জানলেও ১৮৬৩ সালে তিনি কুমারখালীতে একটি মেয়েদের স্কুল নির্মাণ করেন। স্বয়ং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সে সময় স্কুলটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

১৮৫৭ সালে হাতে লেখা প্রকাশনা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা দিয়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। সাত বছর পর ১৮৬৩ সালে কলকাতার গ্রিশ চন্দ্র বিদ্যা প্রেস থেকে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নিয়মিত প্রকাশ করেন। ১৮৭৩ সালে বন্ধু ও সহযোদ্ধা অক্ষয় মৈত্রেয়’র বাবা মথুরানাথ মৈত্রয়’র আর্থিক সহায়তায় কুমারখালীতে এমএন প্রেস গড়ে তোলেন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার মাধ্যমেই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার নীলকরসহ জমিদারদের অত্যাচার ও অনাচারের বাস্তবতা তুলে ধরেন। মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি বিষাদসিন্ধু কাঙাল হরিনাথের এমএন প্রেসেই ছাপা হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও দীর্ঘ ১৮ বছর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর্থিক সংকটের কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়।

অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করে গেছেন হরিনাথ মজুমদার। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন এলাকার অবহেলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। এভাবেই তিনি গ্রামবাসীর হাতিয়ার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন।

পরে সাংবাদিকতা পেশা ত্যাগ করে কাঙাল হরিনাথ ১৮৮০ সালে ফিকির চাঁদের দল নামে একটি বাউল গানের দল গঠন করেন। তার বাউল গানগুলো ফিকির চাঁদের গান হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। তার গানের কথা ও সুরের সহজ ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয়তা পেতে বেশি সময় লাগেনি। হরিনাথের গানগুলো অনেক লেখক, সঙ্গীত বোদ্ধাদের মন জয় করে ও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এরমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম।

ফিকির চাঁদ নিজেই দলবল নিয়ে তার রচিত গান গেয়ে বেড়াতেন। তার সে গান শুনতে স্বয়ং লালন শাহ কাঙাল কুটিরে আসতেন। কাঙাল হরিনাথের উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে- ওহে দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে, তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।

গদ্য এবং পদ্য রচনায়ও হরিনাথ মজুমদার যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁর মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা আঠারোটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে, বিজয় বসন্ত, চারু-চরিত্র, কবিতা কৌমুদী, কবিকল্প, অক্রুর সংবাদ, চিত্তচপলা, কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী।

১৮ এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর “নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো” বলে মন্তব্য করে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা। মৃত্যু পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।

কাঙাল হরিনাথের শেষ ইচ্ছে ছিল তাঁকে যেন পুরোপুরি দাহ্য করা না হয়। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তার হাতের কনিষ্ঠা, মাথার খুলি আর বাম পায়ের বুড়ো আঙুলসহ দাহ শেষে ছাইভস্ম তার নিজের পূজার ঘরে সমাহিত করা হয়।

বর্তমানে কাঙাল কুটিরে বসবাস করছে হরিণাথের পঞ্চম বংশধর স্বর্গীয় অশোক মজুমদারের পরিবার। কাঙালের পুজার ঘরে এখনো দিনে তিনবার পূজা হয়। আর পূজার ঘরে কাঙাল হরিনাথের একটা বাঁধাই করা অস্পষ্ট ছবিসহ তাঁর ব্যবহৃত খড়ম ও তার ত্রিশুল রাখা আছে।

কুমারখালী শহরের সেরকান্দি এলাকায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বহু দর্শনার্থী এই জাদুঘরটি পরিদর্শনে আসেন। পাশাপাশি হরিনাথের বাস্তুভিটা ও তাঁর সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীসহ কাঙাল ভক্তরা। তবে বাউল সাধক ও সাংবাদিক কাঙাল হরিণাথের বাস্তুভিটা এখনও জরাজীর্ণ।

ভয়েস টিভি/ডিএইচ

You may also like