Home সারাদেশ দুইশ বছরেও হয়নি মামলা-মোকদ্দমা, বিশ্ব আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া

দুইশ বছরেও হয়নি মামলা-মোকদ্দমা, বিশ্ব আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া

by Mesbah Mukul

হুলহুলিয়া একটি গ্রামের নাম। নাটোর জেলা শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলায় অবস্থিত। অন্য দশটি গ্রাম থেকে এটি অনেক দিক থেকেই আলাদা। শুধু বাংলাদেশ কেন পুরো বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ বা মডেল গ্রাম হতে পারে- হুলহুলিয়া। এমন একটি গ্রাম থাকতে পারে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য?

স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, কেন অন্য গ্রামগুলো থেকে স্বতন্ত্র এবং বিশ্বের জন্য মডেল হুলহুলিয়া? নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের বক্তব্যেই এর একটি ধারণা পাওয়া যাবে। ডিসি বলেন, হুলহুলিয়া গ্রামে দুইশ বছর ধরে কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমা নেই। গ্রামের সমস্যা গ্রামেই সমাধান করা হয়। বাস্তবতার আলোকে এটি সত্যিই বিস্ময়কর এক গ্রাম।

গ্রামটির প্রবেশ গেটের বাম পাশেই স্থাপিত ডিজিটাল হাব দেখে থমকে যেতে হয়। বিলের মধ্যে এমন আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব! যেখানে কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি ৭২ ইঞ্চি লাইভ টিভি, দুটি ওয়াই-ফাই জোন রয়েছে এখানে। ২০১৬ সালে জেডটিইর আর্থিক সহযোগিতায় ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘হুলহুলিয়া ডিজিটাল হাব’ স্থাপিত হয়। এ পর্যন্ত কয়েকটি গ্রামের ৬৫০ জন শিক্ষার্থীকে ইন্টারনেটে আয়ের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গ্রামটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি কওমি মাদ্রাসা ও কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে।

ডিজিটাল হাবের উল্টো দিকেই মাদ্রাসার পাশে নিজের জমিতে ধান কাটছেন সাইদুল ইসলাম। কতদূর লেখাপড়া করেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এইচএসসি পাস করেছি।’

সাইদুল ইসলাম জানান, তাদের গ্রামের ভ্যানচালকও কমপক্ষে এসএসসি পাস। কারণ এ গ্রামে কমপক্ষে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। আর এটি ১৯৮৫ সাল থেকে হয়ে আসছে। গ্রামের কোনো শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার খরচ না থাকলে তাদের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ সহযোগিতা করে। তাই ৮০ দশকেই শতভাগ শিক্ষিত গ্রামে পরিণত হয় হুলহুলিয়া।

মাদ্রাসা পার হয়ে কয়েক গজ সামনে যেতেই ছোট একটি বাজার। বাজারে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যায়। গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের তখনকার মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ভরে ওঠে ফসলে। এর পর থেকেই গ্রামটির সবাই ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। আর গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় একটি পরিষদ। ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত সেই পরিষদই আজ ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামটি পরিচালিত হয় এই পরিষদের গঠনতন্ত্র দিয়ে।

ডিজিটাল হাবের সঙ্গে অবস্থিত দ্বিতল ভবনটিই হচ্ছে সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ। ভবনটিতে প্রবেশ করলেই হাতের বামে গ্রাম্য আদালত। তার পাশেই লাইব্রেরি ও দ্বিতীয় তলায় কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্টহাউজ। কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্ট হাউজ বিনামূল্যে ব্যবহার করেন গ্রামবাসী।

২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এ ছাড়া পাঁচজন উপদেষ্টা থাকেন কমিটিতে; যারা পরামর্শ দেন। দুই বছর পর পর গ্রামের পুরুষদের প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করে।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ বলেন, কোনো ঝগড়াবিবাদ হলে আমাদের গ্রামের নিজস্ব বিধিবিধান আছে, সেখানেই মীমাংসা করে ফেলি। আমাদের থানা বা কোর্টে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। গ্রামের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়। শতভাগ শিক্ষিত গ্রাম হওয়ায় এখানে নেই কোনো বাল্যবিবাহ। আমরা গ্রাম উন্নয়ন পরিষদের অর্থায়নে বিভিন্ন রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারও করে থাকি। বর্তমানে আমাদের গ্রামের দুই শতাধিক প্রকৌশলী, ১১ জন জজ, শতাধিক চিকিৎসক ও একজন সচিব রয়েছে।

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা জানান, এ গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্যান্য এলাকার চাইতে সন্তোষজনক। এখানকার মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়।

ভয়েসটিভি/এমএম

You may also like