এক সময় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে ধরলা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত চরাঞ্চলের চাষাবাদ হতো সনাতনী পদ্ধতিতে। ফসল হতো খুবই কম। মাসের পর মাস কাউন খেয়ে থেকেছে এ অঞ্চলের মানুষ। তবে সে পরিস্থিতি এখন আর নেই, বদলেছে ভাগ্য।
এমনই একজন কৃষক মো. মজিবর রহমান (৫০)। চর সারোডোবের অন্যান্য পরিবারের মতোই অভাব-অনটন ও দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন পার করেছেন। এখন সেসব তাঁর অতীতের গল্প।
মজিবরের জীবনে পরিবর্তনের শুরু হয় প্রায় আট বছর আগে। দেশি-বিদেশি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় চর সারোডোবের দুয়েকজন কৃষক ততদিনে সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছেন। তাদের দেখাদেখি সনাতন কৃষি পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনিও।
দেশি একটি এনজিও থেকে বীজ সংগ্রহ করে ৫০ শতক জমিতে ভুট্টার চাষ করেন তিনি। ভালো ফলন ও মুনাফা পেয়ে প্রতি বছর ভুট্টা চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন তিনি। একটি ফসলে আটকে না থেকে বৈচিত্র্য আনেন চাষাবাদে। বর্তমানে ভুট্টার পাশাপাশি মরিচ, পেঁয়াজ ও কলা চাষ করছেন মজিবর রহমান। তিনি জানান কৃষি বিভাগের সহযোগিতা বাড়লে এখানকার কৃষকদের আরও ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে।
কয়েক বছর আগেও কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের কৃষকদের খুবই অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করতে হয়েছে। চরের জমিতে তখন কাউন, চিনা, ধান, সরিষা ও গমের বাইরে অন্য কোনো ফসল আবাদ করা সম্ভব হতো না। উপরন্তু সনাতন পদ্ধতিতে আবাদ ও সেচের ব্যবস্থা না থাকায় ফলনও হতো অনেক কম।
কিন্তু বর্তমানে এখানকার কৃষকরা উন্নত জাতের বোরো ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, গম, সরিষা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, আলু, টমেটো, মসুর ডাল, খেসারি ডাল, মুগ ডাল, মরিচ, পেঁয়াজসহ সবজি ও অন্যান্য ফসলও চাষ করতে পারছেন।
কৃষি বিভাগসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় কৃষি পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এগিয়ে চলেছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। কৃষিতেই ভাগ্য বদলেছে দিয়েছে তাদের।
জেলা কৃষি বিভাগ সুত্রে জানাযায়, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় চর রয়েছে সাড়ে চারশোর বেশি। এসব চরের মোট জমির পরিমাণ ৪৬ হাজার ৪২৮ হেক্টর।
এর মধ্যে চাষাবাদ হচ্ছে ৩৫ হাজার ৮৭ হেক্টরে। এসব আবাদি জমির বেশির ভাগেই এখন লাভজনক ফসল ফলাচ্ছেন কৃষকরা। উৎপাদিত ফসল নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পর বিক্রি করছেন বাজারে।
জীবনমান পরিবর্তনে ও কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুই শতাধিক এনজিও। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এসব এনজিও কৃষকদের লাভজনক ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণে কাজ করে যাচ্ছে। বিনামূল্যে সরবরাহ করছে উন্নত জাতের বীজ, সার ও কীটনাশক।বিভিন্ন ফসল, সবজি, ডাল ও তেলবীজ আবাদে সহায়তার পাশাপাশি এসব সংস্থা এখন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনেও সহযোগিতা করছে।
ক্লাইমেট অ্যাকশন নামে একটি এনজিও প্রকল্পের টিম লিডার মো. নাঈম খান জানান, তাদের সংস্থাটি বর্তমানে চরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভালো মানের সবজি বীজ বিতরণের মাধ্যমে তাদের চাষে উৎসাহিত করছে। এজন্য স্থানীয় কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে জৈব সার ব্যবহার করে সবজি আবাদে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
স্থানীয়রা এসব সবজি আবাদের মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজেদের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছেন, তেমনি উৎপাদিত অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবানও হতে পারছেন। এ কারণে সবজি চাষে স্থানীয়দের আগ্রহও ব্যাপকমাত্রায় বেড়েছে। এছাড়া সদস্যদের মুনাফাযোগ্যতা বাড়াতে তাদের ভেড়াও দিয়েছে সংস্থাটি।
সবজি বীজ বিতরণ ও ভেড়া দেয়ার আগে এ নিয়ে উপজেলার কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক সদস্যের ভেড়ার প্রজনন শুরু হয়েছে এবং কোনো কোনো সদস্য আগ্রহী হয়ে নিজ উদ্যোগে আরও ভেড়া কিনেছেন।
চিলমারী উপজেলার চর বজরা দিয়াখাতার বাসিন্দা মিনারা বেগম ফ্রেন্ডশিপ নামে স্থানীয় একটি এনজিও প্রকল্প থেকে শাকসবজি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন। এছাড়া তাকে একটি ভেড়াও দিয়েছিল এনজিওটি। বর্তমানে তার ভেড়ার সংখ্যা আটটি। সবজি বিক্রি ও ভেড়া পালন করেই নিজ সংসারকে সচ্ছল করার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন মিনারা বেগম। সম্প্রতি তিনি একটি গরুও কিনেছেন।
ওই এনজিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, নিয়মিত আয়-রোজগার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রয়াস নিয়েছে তার সংস্থাটি। পাশাপাশি সামাজিক সুশাসন যেমন বাল্যবিবাহ রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদি নিশ্চিতে শিক্ষামূলক আলোচনা আয়োজনের পাশাপাশি দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সামাজিক সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়েও সংস্থাটি কাজ করছে।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. মন্জুরুল হক জানান, চরাঞ্চলসহ জেলার এক লাখ ১৯ হাজার কৃষককে কৃষি প্রণোদনার আওতায় উন্নত জাতের বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে চরাঞ্চলের কৃষকদের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেয়ার পাশাপাশি লাভজনক ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে স্থানীয় কৃষি বিভাগ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন : মুন্সীগঞ্জের চরাঞ্চলে হামলা: গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৫
ভয়েস টিভি/এমএইচ