Home বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারকারী চীনের ইতিহাস

আধিপত্য বিস্তারকারী চীনের ইতিহাস

by Shohag Ferdaus
চীন

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন পূর্ব এশিয়ার একটি জনবহুল রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তাই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। দেশটির আওতায় ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল, চারটি কেন্দ্রশাসিত পৌরসভা, এবং দুইটি প্রায়-স্বায়ত্বশাসিত বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল রয়েছে। চীন বিশ্বের একটি বৃহৎ শক্তি এবং এশিয়া মহাদেশের প্রধান আঞ্চলিক শক্তি।

ইতিহাস থেকে জানা গেছে প্রাচীনকালে চীন ছিল পূর্ব এশিয়ার আধিপত্য বিস্তারকারী সভ্যতা। এ অঞ্চলের অন্যান্য সভ্যতা জাপানি, কোরীয়, তিব্বতি, ভিয়েতনামীয়, এদের সবাইকে চীন প্রভাবিত করেছিল। তারা চীনের শিল্পকলা, খাদ্য, বস্তুসংস্কৃতি, দর্শন, সরকার ব্যবস্থা, প্রযুক্তি এবং লিখন পদ্ধতি গ্রহণ ও অনুসরণ করত। বিশেষ করে ৭ম শতাব্দী থেকে ১৪ শ শতাব্দী পর্যন্ত চীন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর সভ্যতা। কাগজ, ছাপাখানা, বারুদ, চীনামাটি, রেশম এবং দিকনির্ণয়ী কম্পাস প্রথম উদ্ভাবিত হয় চীনে। এবং সেখান থেকে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।

১৯ শতকে অভ্যন্তরীণ বিপ্লব এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের ফলে চীনের শেষ রাজবংশ কিং দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১১ সালে চীনা জাতীয়তাবাদীরা শেষ পর্যন্ত এই রাজতন্ত্রের পতন ঘটায়। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক ধরে একাধিক সামরিক নেতার অন্তর্কোন্দল, জাপানি আক্রমণ, এবং সাম্যবাদী ও কুওমিনতাঙের জাতীয়তাবাদী সরকারের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ দেশটিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে এবং চীনের মূল ভূখণ্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।গণচীনের বর্তমান সংবিধান ১৯৫৪ সালে প্রথম গৃহীত হয় এবং এতে দেশের শাসনব্যবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। দেশের ৭ কোটিরও বেশি লোক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

১৯৮০-র দশকের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর থেকে চীনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে এবং স্থানীয় সরকারের নেতাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের মৌলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি গণ কংগ্রেসব্যবস্থা নামে পরিচিত। চীনের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় গণ কংগ্রেস চীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ সংস্থা। ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ কক্ষ।

ভূমিরূপ

চীন একটি পর্বতময় দেশ। দেশটির মোট আয়তন প্রায় ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ পর্বত, ছোট পাহাড় এবং মালভূমি নিয়ে গঠিত চীন। কয়েক মিলিয়ন বছর আগে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি সৃষ্টি হয়। আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে চীনের ভূভাগ সিঁড়ির মতো পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির গড় উচ্চতা ৪ হাজার মিটারের বেশি বলে মালভূমিটি ‘বিশ্বের ছাদ’ নামে পরিচিত; এটি চীনের ভূমিরূপের প্রথম সিঁড়ি গঠন করেছে।

স্থলভূমির আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের ৩য়/৪র্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র। দেশটির প্রধান প্রধান নগর অঞ্চলের মধ্যে সাংহাই, কুয়াংচৌ, বেইজিং, ছোংছিং, শেনচেন, থিয়েনচিন ও হংকং উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে বেইজিং হলো দেশেটির রাজধানী। দেশটির মুদ্রার নাম ইউয়ান।

চীনের উত্তরে রয়েছে মঙ্গোলিয়া; উত্তর পূর্বে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া; পূর্বে চীন সাগর; দক্ষিণে ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার, ভারত, ভূটান, নেপাল; দক্ষিণ পশ্চিমে পাকিস্তান; পশ্চিমে আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান ও কাজাকিস্তান। এই ১৪টি দেশ বাদে চীনের পূর্বে পীত সাগরের পাশে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান; দক্ষিণ চীন সাগরের উল্টো দিকে আছে ফিলিপাইন।

ভাষা

চীনারা তাদের দেশকে চুংকুও নামে ডাকে, যার অর্থ মধ্যদেশ বা মধ্যবর্তী রাজ্য। চীন নামটি বিদেশিদের দেয়া। এটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের চীন রাজবংশের নামের বিকৃত রূপ। চীনের সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষাগুলো চৈনিক-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও চীনা ভাষার ভেতরে একাধিক উপ-ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষাগুলো হলো ম্যান্ডারিন চীনা ভাষা। চীনা জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এ ভাষায় কথা বলে। আদর্শ বা প্রমিত চীনা ভাষা ম্যান্ডারিন বেইজিং উপভাষার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট হয়েছে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের জাতীয় ভাষা।

পতাকা

চীনের জাতীয় পতাকাটি পাঁচ তারকা খচিত একটি লাল পতাকা। এর দৈর্ঘ্য ও উচ্চতার অনুপাত হল ৩:২। চীনের জাতীয় পতাকার লাল রঙ বিপ্লবের নিদর্শন। পতাকায় পাঁচটি হলুদ রঙের তারকা আছে, যাদের মধ্যে একটি বড় ও মূল তারকা। এটি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী জনগণের ঐক্যের নিদর্শন।

চীনের জাতীয় সঙ্গীত মূলত এক বীরবাহিনীর অগ্রযাত্রার গান। গানটি ১৯৩৫ সালে রচনা করা হয়। গানের কথাগুলো লিখেছে নাট্যকার থিয়েনহান, আর এটিতে সুর দিয়েছে চীনের নতুন সংগীত-আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নিয়ের আর। গানটি প্রকৃতপক্ষে ‘সংগ্রামের অগ্রগামী সন্তানেরা ’ নামক চীনা চলচ্চিত্রের থিম- সং।

পরিবহন

১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে দেশটির পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। নিত্যনতুন বিমানবন্দর, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পসমূহ আগামী দশকগুলিতেও চীনের শ্রমবাজারে বিপুল পরিমাণে কাজ সৃষ্টি করবে। রেলপথ চীনের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা। বিংশ শতকের মধ্যভাগের তুলনায় বর্তমান চীনের রেলপথের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ হয়েছে। একটি বিস্তৃত রেলব্যবস্থা বর্তমানে সমগ্র চীন জুড়ে প্রসারিত। বড় বড় শহরগুলিতে রয়েছে পাতাল রেল ব্যবস্থা।

অর্থনীতি

১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর চীনের কমিউনিস্ট সরকার কৃষি ও শিল্পব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অধীনে নিয়ে আসে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ থেকে সরকার অবশ্য অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করে যাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য পদ অর্জন করে। ধীরে ধীরে চীনা অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে চীনে সৃষ্টি হয় নতুন গতিপথ। বর্তমানে ক্রয়ক্ষমতার সমতার বিচারে চীনের অর্থনীতি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম। আর বিশাল জনসংখ্যার কারণে, চীনের মাথাপিছু আয় ৬,২০০ মার্কিন ডলার যা আমেরিকার এক সপ্তমাংশ।

পর্যটন

এদিকে দেশটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের দিক দিয়েও খুবই সমৃদ্ধ। চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, নদী, সমুদ্রসহ আধুনিক নগরায়ণের জন্যই সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আর তাই চীন বিশ্বের পর্যটন গন্তব্যস্থলগুলির মধ্যে অন্যতম।

চীনের জায়ান্ট পাণ্ডা শুধুমাত্র চীনা পর্যটকদের কাছেই জনপ্রিয় না, এই প্রাণীটি পৃথিবী জুড়ে শিশু থেকে শুরু করে সবার কাছে জনপ্রিয়। সবচেয়ে বেশি জায়ান্ট পাণ্ডার দেখা মেলে সিচুয়ান প্রদেশের চেংদু শহরে – যা জায়ান্ট পাণ্ডার হোমটাউন হিসেবে পরিচিত।

আরেকটি দর্শনীয় এবং জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হল বেইজিং এর নিষিদ্ধ নগরী। এখানে চীনের প্রাচীন স্থাপত্যবিদদের দ্বারা নির্মিত এই প্রাসাদটিতে চার হাজারেরও বেশি সুসজ্জিত কামড়া রয়েছে। এসব কামড়াগুলিতে আছে লাল এবং হলুদ রংয়ের কারুকার্য। এই প্রাসাদের ছাদ সোনা দিয়ে তৈরি।

চীনে ভ্রমণের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে চীনের মহাপ্রাচীর ‘দ্যা গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাচীর ও চীনের প্রতীক। প্রাচীরটি চীনের পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫,০০০ কিলোমিটার। আর উচ্চতা প্রায় ৬ থেকে ৮ মিটার এবং কিছু কিছু জায়গায় প্রায় ১৬ মিটার পর্যন্ত। চীনের এই প্রাচীরটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি।

দেশটির দর্শনীয় স্থানগুলোর কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। তবে- রেইনবো মাউন্টেইন, লাসায় অবস্থিত পোতালা প্রাসাদ, সাংহাই এর দ্যা বান্ড, ভিক্টোরিয়া হারবার, হুয়াংশান এর হলুদ পাহাড় , হংজৗ এর ওয়েস্ট লেক, লেশান জায়ান্ট বুদ্ধ, হানি টেরেস, লংমেন গুহা, ইয়ুংগ্যাং গুহা অন্যতম ।

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like