চোরাচালাননির্ভর হয়ে পড়েছে দেশে সোনার ব্যবসা। সুযোগ থাকলেও আমদানি হচ্ছে খুবই কম। বেশিরভাগই আসছে চোরাই পথে। এজন্য গড়ে উঠেছে বিশাল এক সিন্ডিকেট। তারা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধভাবে এবং চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধসহ নানা উপায়ে সোনা আমদানি করছে। এতে সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব; আর অন্যদিকে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা।
প্রতিটি সোনার বার শুল্ককর দিয়ে আনা হলেও বাজারমূল্যের চেয়ে গড়ে ১০ হাজার টাকা দাম কম পড়ে। আবার সোনার বারে খাদ মেশানোর পর মূল্য সংযোজন আরও বেশি হয়। এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে এক-দুটি করে সোনার বার নিয়ে আসছেন সোনা ব্যবসায়ীরা। সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে সোনার বার আনার ক্ষেত্রে শুল্ক কর বাবদ বাড়তি খরচ হলেও ঝুঁকি অনেক কম। এজন্য এখন যাত্রীদের মাধ্যমে ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধভাবে সোনার বার আনার ঘটনা বাড়ছে।
ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বৈধভাবে শুল্ক-কর দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ ভরি বা দুটি সোনার বার আনতে পারেন। এজন্য প্রতি ভরিতে শুল্ক-কর দিতে হয় ২ হাজার টাকা। সোনার বারের বাইরে ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারবেন বিনা শুল্কে। এর আওতায় বিদেশ থেকে আসা শ্রমিক বা অন্য কোনো যাত্রীর কাছে একটি সিন্ডিকেট এসব সোনা দিয়ে দিচ্ছে। দেশে আসার পর কাস্টমস পার হওয়ার পরই ওই সোনা সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে এখন দেশে সোনা আসছে।
সোনার ব্যবসা বৈধতার মধ্যে আনতে ২০১৮ সালে সরকার সোনা নীতিমালা করেছে। ওই নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে সোনা আমদানি করতে পারে। কিন্তু আমদানিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ একেবারেই কম। নীতিমালার আওতায় গত এক বছরে ২৫ কেজি সোনা আমদানি করেছে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমদানির জন্য এলসি খুলেছে।
এক বছরে ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ সোনা আমদানি করেছেন, তার চেয়ে ৪৩ গুণ বেশি সোনা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে এক মাসে এনেছেন প্রবাসীরা। নভেম্বরে এ বিমানবন্দর দিয়ে ৯৩ হাজার ৬৭০ ভরির সমপরিমাণ ৯ হাজার ৩৬৭টি সোনার বার এসেছে, কেজির হিসাবে যার পরিমাণ ১ হাজার ৯২ কেজি বা এক টনের বেশি। বৈধপথে আমদানির সুযোগ দেয়ার পরও দেশে সোনা চোরাচালান থামছে না। প্রায় প্রতিদিনই দেশে সোনার চোরাচালান ধরা পড়ছে।
যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েকগুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা শুল্ক গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের। সোনা নীতিমালার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ হাজার কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির তথ্যমতে বছরে দেশে সোনার চাহিদা ২১ মণ। এর মধ্যে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানি হয় ১ হাজার কেজির কম। মাঝে-মধ্যে এর পরিমাণ বেড়ে যায়। চোরাচালানের মাধ্যমে আটক হয় গড়ে ২ হাজার কেজি।
এর বাইরে আরও কমপক্ষে ৪৩ গুণ সোনা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসে আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বৈধভাবে আমদানির পরিমাণ খুবই কম। তাই এখন বলা যেতেই পারে, দেশের সোনার বাজার প্রায় পুরোটাই চোরাচালাননির্ভর। কেননা বৈধ উপায়ে যে সোনা আসে তা দিয়ে এক মাসের চাহিদাও মিটবে না।
এদিকে সোনা আমদানিতে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে স্বর্ণ নীতিমালা শিথিলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফলে স্বর্ণের আকরিক আমদানিরও অনুমতি দেয়া হবে। যেন স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা দেশে গড়ে উঠে। বর্তমানে শুধু সোনার বার ও অলঙ্কার আমদানির অনুমতি আছে। আকরিক আনার কোনো অনুমতি নেই।
দেশের অবৈধ সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে শতাধিক চক্র। মূলত তাদের নিয়ন্ত্রণেই পাচার হচ্ছে সোনার চালান। এ চক্রগুলো অবৈধ সোনার চালানের বেশিরভাগ অংশই আবার পাচার করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। আর এসব চক্র ঢাকার শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেশ সক্রিয়।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে করোনার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বার আনেন। নভেম্বরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় এক টনের সমপরিমাণ সোনার বার এসেছে। পাঁচ হাজার যাত্রী এসব সোনার বার এনেছেন। এর বাজারমূল্য ৫৫০ কোটি টাকা। এক মাসে এত বিপুল পরিমাণ সোনার বার আসার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ সোনা ব্যবসায়ীরা। করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বেশ উঠানামা করছে। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। ১ আগস্ট তা বেড়ে ২ হাজার ৫০ ডলারে উঠে।
ডিসেম্বরের দিকে স্বর্ণের দাম বেড়ে ১ হাজার ৯৫০ ডলারে উঠেছিল। এখন আবার তা কমে ১ হাজার ৮৭৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে জমা রয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার স্বর্ণ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে স্থায়ী ও অস্থায়ী খাত মিলে সোনা জমা রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮৬৫ কেজি। এর মধ্যে অস্থায়ী খাতে ২ হাজার ৮১৯ কেজি অস্থায়ী ও স্থায়ী খাতে ৪৬ কেজি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দামে এর আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় অঙ্কের সোনা রয়েছে। এর পরিমাণ ১৪ হাজার ১১০ কেজি। যার মূল্য ৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
ভয়েসটিভি/এএস