Home মুক্তমত টেলিভিশন সাংবাদিকতা চর্চা

টেলিভিশন সাংবাদিকতা চর্চা

by Amir Shohel

সাংবাদিকতা নিয়ে লেখা সত্যাই খুব মুশকিল। কারণ যেনতেন লোক সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেয় না। যারা অনেক কিছু বোঝে, অন্য সবার থেকে একটু বেশি বোঝে, বেশি জানে, জানার চেষ্টা করে এবং নিয়মিত চর্চা করে; তারাই মূলত সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে বেছে নেন। একিন্তু চারটিখানি কথা নয়। একজন সাংবাদিকের কাছে শুধু দেশ নয়; বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ নানা ভূ-সমীকরণের খবর থাকে। আর এর সঠিক বিশ্লেষণও সাংবাদিকদের কাছেই পাওয়া যায়। যা সবাই জানে।

আমার মনে হয়- সব সাংবাদিকেরই একটি অভিজ্ঞতা আছে; কোনো গ্রাম বা শহরের চায়ের দোকান। হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক আড্ডা। সেখানে কোনো সংবাদিক যাওয়া মাত্রই সবাই থেমে গেছেন। ‘এবিষয়ে সাংবাদিক ভাই আপনি বলেন’। এর অর্থ হলো- সাংবাদিক সব জানে এবং সঠিক জানে। তাই তাদের কাছে সবারই জানার আগ্রহ। এই জন্যে সাংবাদিকদেরও সঠিক জানা এবং সঠিকভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি।

আমি আগেই নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি সাংবাদিকরা জ্ঞানী। তাই জ্ঞান দেয়ার কোনো রকম ইচ্ছা আমার নেই। এই ধৃষ্টতা দেখাতেও চাই না। সম্পাদনা ডেস্কের কিছু অভিজ্ঞতা জানাবো- এমন ভেবেছিলাম। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিভ্রাট- সেই সময় কেড়ে নিয়েছে। বিষয়টি একটু বাড়িয়ে বললে বুঝতে সহজ হবে।

মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বিভ্রাট থাকলেও বিকল্প মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে। পত্রিকা বা টেলিভিশনে মোবাইল ফোনে কোনো খবর জানাতে খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে কোনো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কী-না। জরুরি হলে অবশ্যই কয়েকটি মাধ্যমে অফিস বা ডেস্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কোনোভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই- সবার ফোন ব্যস্ত ছিল বা দায়িত্বশীল কেউ ফোন ধরেননি।

টেলিভিশনের সাংবাদিকরা লক্ষ্য করে থাকবেন- কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা একটি টেলিভিশনে ব্রেকিং যাওয়া মাত্রই পরপর সবগুলো টেলিভিশনে অনএয়ার হয়। হতে পারে সবাই এক সঙ্গে অফিসকে জানায়। আবার এও হতে পারে একটি টেলিভিশন দেখে অন্যরাও অনএয়ার করে। আদালতের কোনো রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। তবে যখন অন্য ঘটনাগুলো একইভাবে অনএয়ার হয়, তথনই প্রশ্ন ওঠে। আর যখন সব টেলিভিশনে একযোগে ব্রেকিং/টিকারে ভুল সংবাদ অনএয়ার হতে থাকে; তখন এর উত্তর সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। যেকোনো এলাকার সাংবাদিক যদি নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন; তাহলে ওই টেলিভিশন কখনই বিভ্রান্তিতে পড়বে না। যতক্ষণ না আপনি সংবাদটি দিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার ডেস্ক অপেক্ষা করবে। আর মৃত্যুর সংবাদ অবশ্যই কয়েকটি মাধ্যমে যাচাই করে তবেই ডেস্ককে জানানো উচিত। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সংখ্যা বিভ্রাট থেকেই যায়। এর সহজ সমাধান হতে পারে ঘটনাস্থল, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং হাসপাতাল। এর যেকোনো একটি সূত্রের তথ্য নিয়েই ডেস্কে জানানো উচিত নয়। কারণ কম বা বেশি হতেই পারে। যে ভুলের মাশুল কোনোভাবেই পূরণ হতে পারে না। কেননা সঠিক খবর আসার আগেই কয়েকটি সংবাদে তা প্রচার হয়ে যায়। একারণে সতর্ক হওয়া দরকার।

আগে সাংবাদিক মানেই ছিল পত্রিকার। হাতে বুম না থাকলে এখনও পরিচয় দিলেই প্রশ্ন আসে- কোন পত্রিকার? তার মানে, এখনও অনেকেই মনে করেন সাংবাদিক মানেই পত্রিকার। অথচ টেলিভিশন, বেতার এবং সংবাদ সংস্থাসহ এখন কতো গণমাধ্যম। তাই, কে সাংবাদিক; আর কে সাংবাদিক নয়, বুঝে ওঠা মুশকিল। অবশ্য প্রযুক্তির কল্যাণে এই অবস্থা। সবাই খবর জানেন এবং কোনো খবর জেনে সাংবাদিকের জন্য কেউ আর অপেক্ষা করে না। যে যার মতো তা প্রকাশ বা প্রচার করে দিচ্ছে। পাঠক বা দর্শক সাংবাদিকের অনেক ভিডিও বা স্থিরচিত্রও বেশ আলোচনায় এসেছে। এবং বুলেটিনে গুরুত্বও পেয়েছে। তাই এই উৎসুক মানুষগুলোকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের কারণেও অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা উঠে এসেছে। যা শুধু খবরের খোরাকই হয়নি, সেইসব দুর্বৃত্তরা বিচারের আওতায়ও এসেছে। আগেকার দিনে শুধু সাংবাদিকদের কল্যাণেই এই নজির সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়টি তুলে ধরার অর্থ এই, খবর এখন সবার কাছে; তাই চোখ-কান খোলা রাখুন।

বিভাগ বা জেলা শহর থেকে প্রতিদিন বেশকিছু খবর ডেস্কে আসে। সেগুলো প্রিন্ট করে সংশ্লিষ্ট বুলেটিনের নিউজ এডিটর বা ডিএনই-কে দেখানো হয়। তারা গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা নিতে বলেন। ভাবুন সারাদেশের খবর। সেখানে আপনার খবরটিও আছে। আপনি টেলিভিশনের সংবাদিক। কিন্তু সাংবাদিক মানেই পত্রিকার। সেই প্রভাবই যদি থেকে যায়। তাহলে রীতিমত বিভ্রান্তি। মানে, একটি ঘটনা কয়েক পাতা লিখে পাঠিয়েছেন। যা পত্রিকার সাংবাদিক গুরুত্ব বিবেচনায় প্রয়োজনে পাঠাতে পারে। আপনি টেলিভিশনের সাংবাদিক। কোনো ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, একটি ছোট ঘটনা (উভ নিউজ), বুলেটিনে কত সেকেন্ড অনএয়ার হয়, সে ধারণা নিশ্চয় আপনার আছে। খুব বেশি হলে ৫০টি শব্দ। মানে ২৫ সেকেন্ড। যা আপনি পাঠিয়েছেন দু’পাতা বা দেড়পাতা। যা দু’তিন’শো শব্দের গাঁধুনি। কখনই কাম্য নয়। অনএয়ার দেখে আজ থেকেই শিখুন বা সহকর্মীদের সহায়তা নিন। দেখবেন যেকোনো ঘটনা দ্রুত লিখে ডেস্কে পাঠাতে পারছেন। আর যেভাবে পাঠাচ্ছেন, অনেকটা সেভাবেই অনএয়ার হচ্ছে। আর বড় বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (প্যাকেজ নিউজ)। এই খবর পাঠাতে কেউ কেউ চার পাতাও লিখে পাঠান। আপনার সেই খবরটি ক’মিনিট অনএয়ার হচ্ছে। লক্ষ্য করুন- একটি প্যাকেজ নিউজের স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হয় বেশি হলেও ৯০ বা ১০০ শব্দের। সেখানে বক্তব্য সংযুক্ত করে দেড় মিনিট বা বেশি হলে দুই মিনিট অনএয়ার হয়। গাঁধুনিটা এভাবে হলে কখনই আপনার প্যাকেজ নিউজ ডেস্কে পড়ে থাকবে না। তাই এই সহজ কাজটি শিখে নিন। কয়েকদিন মন দিয়ে টেলিভিশনের বুলেটিন দেখুন- খুব সহজে প্যাকেজ নিউজও ছোট করে লিখতে পারবেন। অনেকে বলেন, ডেস্কের বোঝার জন্য বেশি করে পাঠাচ্ছেন। কেউ বলেন, সব করে দিলে ডেস্কের কাজ কী। এরকম অনেক ধরনের অজুহাত শোনা যায়। বিষয়টি হলো নিজেকে তৈরি করার ব্যাপার। টেলিভিশন নিউজের নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ করে খবর পাঠান। কাউকে ফোন করতে হবে না। সব অনএয়ার হবে। বেশি লিখে পাঠাবেন, ডেস্কেই পড়ে থাকবে বা থাকছে আপনার অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করা খবরটি।

আরও পড়ুন : ‘গল্পে আড্ডায় সাংবাদিকতা’

সাংবাদিককে অবশ্যই কিছু অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। নিয়মিত টেলিভিশন দেখা, শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা এবং চর্চার মধ্যে থাকা। এগুলো ভালো সাংবাদিকের গুণ। যখন আপনার টেলিভিশন দেখার সুযোগ নেই। অন্য কাউকে দেখতে বলুন, কী-কী খবর প্রচার হয়েছে জেনে রাখুন। কোন ধরনের খবর গুরুত্ব পাচ্ছে, এথেকে তাও জানা যাবে। আর আপনার খবরটি প্রচার হলো কী-না, সেটা জানাও জরুরি।

শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা কঠিন কিছু নয়; শুধু একটু সতর্ক হলেই সম্ভব। যদি খুব বেশি জড়তা থাকে, আবৃত্তি সংগঠনে কিছুদিন ক্লাস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। অথবা ঘরে বসে কিছু শব্দ নিয়ে কাজ করলে সব জড়তা কেটে যাবে। বর্তমানে খবরে নিজে ভয়েজ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কেউ ভয়ে দিচ্ছেন না, কেউ আঞ্চলিকতা দূর করতে পারছেন না। এরকম নানা কারণ আছে। তবে কিছু সমস্যা থাকবেই। এরপরও নিজেকে তৈরি করা সম্ভব।

শব্দ নিয়ে যেমন চর্চা করতে হবে; তেমনি সোর্স তৈরি এবং দেশ-বিদেশের ঘটনাবলি জানার চেষ্টা থাকতে হবে। সবসাময়িক ঘটনা অনুসরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে অবশ্যই রাজনৈতিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তবে সব চর্চার প্রতিফলনই যে খবরে পড়বে, তা নয়। তবু নিজেকে তৈরি করতে এরচেয়ে বড় মাধ্যম আছে বলে আমার জানা নেই।

দেশে জঙ্গি গোষ্ঠির মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা বিভিন্ন সময় লক্ষ্য করা গেছে। এই গোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠেছে। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই খবরগুলোকে গুরুত্ব দেয়া এবং ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি। তাই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যদেরও সচেতন করতে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু জঙ্গিবাদই নয়; সংক্রামক যেকোনো কিছুর বিরুদ্ধেই সংবাদিকের ভূমিকা থাকতে হবে অগ্রগণ্য।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
rizvynca@gmail.com

You may also like