সম্পূর্ণ ডিজিটাইজ হচ্ছে শেয়ারবাজার। এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। বিনিয়োগকারীদের হায়রানীতে পড়তে হবে না। দৌড়াদৌড়ির দিনও শেষ হচ্ছে। ডিজিটাইজ হলে যে কেউই ঘরে বসে সব করতে পারবেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আনজাম খালেক।
দেশে প্রথম ১৯৫৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই) নাম নিয়ে শেয়ারবাজারের আনুষ্ঠানিক লেনদেন শুরু হয় নারায়ণগঞ্জে। স্বাধীনতার পর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালে মাত্র ৯টি তালিকাভুক্ত কম্পানি নিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে ডিএসই। আর ১৯৯৫ সালে জন্ম হয় দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই)। কিন্তু দুই শেয়ারবাজারেই জন্মের পর থেকে এখনো কাগুজে রীতি চলছে। দেশের প্রায় সব সেক্টর ডিজিটাল হলেও এর ছোঁয়া লাগেনি শেয়ারবাজারে।
দেশের শেয়ারবাজার যে কতটা পিছিয়ে আছে, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে সর্বশেষ করোনাকালের লেনদেন বন্ধ রাখা। ২০২০ সালে শেয়ারবাজার ৬৬ দিনের জন্য বন্ধ ছিল। করোনায় সাধারণ ছুটির মধ্যে ব্যাংক খোলা থাকলেও বন্ধ ছিল শেয়ারবাজার। বিশ্বের কোনো শেয়ারবাজার করোনা সংকটে এত দীর্ঘ সময় লেনদেনবিহীন ছিল না। এর প্রধান কারণ সেই কাগুজে লেনদেন। লেনদেনের জন্য প্রধান সংস্থাগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ছিল না।
বহির্বিশ্বের ৫০ শতাংশ শেয়ারবাজারের লেনদেন যেখানে অনলাইনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে নগণ্য। এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরো শেয়ারবাজারকে ‘ডিজিটাল’ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য সরকার বিশ্বব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অব দ্য বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মাত্র ৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্পে পুরো শেয়ারবাজারে আমূল পরিবর্তন আসবে।
‘করোনাকালে পৃথিবীর মধ্যে যে দু-তিনটি দেশের শেয়ারবাজার বন্ধ ছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের শেয়ারবাজারকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা এবং প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কী কী পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি ধারণাপত্র পাঠিয়েছে।
বিএসইসি ধারণাপত্রে বলেছে, “শেয়ারবাজার এখনো ‘সেকেলে’। শেয়ারবাজারের প্রতি পদে কাগুজে সিস্টেম; কম্পানি তালিকাভুক্তি থেকে শুরু করে শেয়ার কেনাবেচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত। এমনকি ‘মার্কেট রেগুলেটরি বডির’ বাজার মনিটরিংয়েও দুর্বলতা এ জন্য। এখানে অত্যাধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার খুব কম। দেশের শেয়ারবাজারকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রধান অন্তরায়। এর ফলে তথাকথিত ‘মার্কেট প্লেয়াররা’ সহজেই বাজার নিয়ে খেলতে পারে। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি হারাচ্ছে, আস্থা হারাচ্ছে।
বিনিয়োগকারীরা যেন ঘরে বসেই সব করতে পারেন, সে জন্যও ‘ফিনটেক মেথড’ ব্যবহার করা হবে। তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী কম্পানিগুলো ঘরে বসেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সব কার্যক্রম শেষ করতে পারবে। ‘ফিনটেক মেথড’ বহুল জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে কেউ ঘরে বসেই আর্থিক লেনদেনের কাজ করতে পারে। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং এর একটি বড় উদাহরণ।
বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি অনলাইন ট্রেডিং সিস্টেম চালু করা হবে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই লেনদেন করতে পারবেন ঘরে বসে। ব্রোকারেজ হাউসে আসার আর প্রয়োজন হবে না। লাগবে না কারো সাহায্য। শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সবার জন্য আসবে নতুন পেমেন্ট সিস্টেম। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে ডিএসই, সিএসই থেকে শুরু করে ব্রোকারেজ হাউস—সব প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকবে। এতে খরচ হবে অনেক কম। সব কিছু হবে ডিজিটাল ডকুমেন্টিংয়ে। শেয়ারবাজারের সব স্টেকহোল্ডারকে ‘ডিজিটাল ইকো সিস্টেমে’ আনা হবে। এগুলোর সার্বিক তদারকি করবে সরকার।
১৯৯৬ ও ২০১০ সালে দেশের বিনিয়োগকারীরা স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ধস দেখেছেন। কোটি বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন, লাভ হয়েছে কারসাজিচক্রের। এখনো এসব কারসাজিচক্র সক্রিয়। এরা যেন ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীদের টাকা লুটে নিতে না পারে, সে জন্য পুরো সিকিউরিটি সিস্টেম ঢেলে সাজানো হবে। এ জন্যে বিএসইসির তত্ত্বাবধানে গঠন করা হবে একটি ডাটা ইন্টারঅপারেবিলিটি (ফিনটেক) বোর্ড। এই বোর্ড উন্নত প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবে। বোর্ডটি শেয়ারবাজারের সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করবে।
শেয়ারবাজার ডিজিটাইজ করতেই এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। এ ছাড়া ‘সাবসিডাইজিং দ্য ইন্ট্রোডাকশন অব এন্ড টু এন্ড অনলাইন ট্রেডিং ফর ব্রোকার্স’ শীর্ষক খাতে চার বছরে ব্যয় করা হবে ২০ লাখ ডলার বা ১৬ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।