- লাউয়ের খোলকে একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পানি সংরক্ষণের পাত্র বানিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন পাহাড়ের কয়েকটি জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে বান্দরবানে ম্রো ও খুমী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম জিনিসের পরিবর্তে এখনও লাউয়ের খোল ব্যবহার করছেন।
লাউয়ের খোল ব্যবহার একদিকে পরিবেশবন্ধব, অন্যদিকে এই খোলের পানি ঠান্ডা থাকে। গরমকালে জুমক্ষেতে কাজ করার ফাঁকে পানিভর্তি লাউয়ের খোল অনেকে কলা গাছের গোড়ায় গর্ত করে পুঁতে রাখেন। ঘন্টা দুয়েক পরে এর পানি ফ্রীজে রাখার মত ঠান্ডায় জমে যায়। অভ্যস্ততা না থাকলে বাচ্চারা হঠাৎ খেলে অনেক সময় সর্দি-কাশি লেগে যায়।
লাউয়ের খোল ব্যবহারকারী ম্রো ও খুমীরা বলছেন, এই লাউয়ের খোলে অন্তত এক সপ্তাহ পানি রাখা যায়। আর এই পানি গরমকালে বেশ ঠান্ডাই থাকে। এছাড়া লাউ খোলের ভেতরের অংশ পানিকে আরও বিশুদ্ধ করে। ঝিরি-ঝরণার পানি অপরিষ্কার থাকলে এর ময়লা পাত্রের একটা নরম অংশ আপনা-আপনিই পরিশুদ্ধ করে।
এখনও ম্রো ও খুমীদের গ্রামে গেলে এদের প্রত্যেকের ঘরে এর ব্যবহার দেখা যায়। একটা-দুইটা নয়, কারও বাড়িতে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশটা এই লাউয়ের খোল পাত্র থাকে। তবে ত্রিপুরা এবং বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে লাউয়ের খোলের ব্যবহার থাকলেও তা শুধুমাত্র দুর্গম এলাকা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী চিংতুই ম্রো ও রুইতন ম্রো বলেন, “এটিকে আমরা ঘরে এবং ঘরের বাইরে পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। ঘরে অনেকগুলো লাউয়ের খোলে পানি জমা করে রাখা হয়। আবার ক্ষেতখামারে গেলে পানি ভরে নিয়ে যাওয়া যায় খাওয়ার জন্য”।
”একসময় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জগ পর্যন্ত ছিল না। পানি রাখার জন্য তখনকার সময় প্লাস্টিকের কোন কিছুই বের হয়নি। জগের বিকল্প হিসেবে লাউয়ের খোল ব্যবহার করে আসছি। বলা যায় এটি একধরণের পাহাড়ি জগ।”
তাইলেং নামে এক ম্রো নারী জানান, “প্লাস্টিকের বোতলে পানি রাখলে খাওয়ার সময় প্লাস্টিকের মত গন্ধ আসে। বরং লাউ খোলের পানি খেতে ভাল লাগে। দীর্ঘদিন ব্যবহার করে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। গরমকালে এই পাত্রের পানি ঠান্ডা হয়ে থাকে”। তার ঘরে কমপক্ষে ৪০টি লাউয়ের খোল রয়েছে বলে জানান তিনি।
দীর্ঘ সময় ধরে লাউয়ের খোল পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন খুমীরাও। তাদেরও ঘরে ঘরে রয়েছে এই লাউ খোলের পানির পাত্র। একসময় দুর্গম পাহাড়ে লাউয়ের খোল ছাড়া পানি ধরে রাখার বিকল্প উপায় ছিল না। তখন থেকে তাদের ঘরে লাউয়ের খোল ব্যবহারের প্রচলন ঘটে।
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ও খুমী সোস্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সিংঅং খুমী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা এখনও ঝিরি-ঝরণা এবং খালের পানির উপর নির্ভরশীল। ঘরে পানি সংরক্ষণ করে রাখার কোন উপায় ছিল না। ব্যবহারের জন্য এক সময় কোন কলস ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র পর্যন্ত ছিল না”।
”আমাদের আগের প্রজন্মের বয়োজ্যেষ্ঠরা লাউয়ের খোলে বিশেষ কায়দায় পানি সংরক্ষণ করে রাখত। এখনও দুর্গম এলাকার বেশিরভাগ খুমী বাসিন্দা লাউয়ের খোলের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে। আর লাউয়ের খোলের পানিই খায়।”
লাউয়ের খোল থেকে কিভাবে তৈরি হয় ‘পানির পাত্র’
সুন্দর ও ভাল আকৃতির পরিপক্ক দেখে লাউ সংগ্রহ করা হয় প্রথমে। ছিদ্র করে ভেতরে পানি জমিয়ে রেখে পঁচানো হয় ভেতরের অংশ। পনের-বিশ দিন পর পঁচা অংশ ফেলে দিয়ে পরিস্কার করে নিতে হয়। তারপর ভাল করে শুকানো হয় রোদে। শুকনো লাউকে ঘরে চুলার উপর ঝুলিয়ে রাখা হয় কয়েক মাসের মত। এতে করে বাইরে অংশ কালো হয়ে উঠে। তারপর ভাল করে ধুয়ে ব্যবহার করা হয় পানির পাত্র হিসেবে।
তবে যেগুলো পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয় সেগুলোতে জুমের বিভিন্ন বীজ রেখে দেওয়া হয়। জুমবীজ ছাড়াও ঘরে হলুদ এবং লবণের পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এ লাউয়ের খোল। ফেটে না গেলে কিংবা না ভাঙ্গলে এই লাউয়ের খোল অনেক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
ভয়েস টিভি/এসএফ