Home ধর্ম দাম্পত্য জীবন

দাম্পত্য জীবন

by Amir Shohel

বিয়ের মধ্য দিয়ে দু’জন নর ও নারী যে জীবন শুরু করে তারই নাম দাম্পত্য জীবন। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি যা দাবি করে ইসলাম মূলত তাই। এ জন্য ইসলামকে বলা হয় সহজ ও প্রকৃতির ধর্ম। নর ও নারীর প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক-প্রকৃতিগত (আল্লাহ প্রদত্ত) এবং পরস্পর একত্র হওয়ার মধ্যে রয়েছে প্রশান্তি। পরস্পর একত্র হওয়াকে ইসলাম একটি শৃঙ্খলার মধ্যে এনেছে এবং এটিকে বলগাহীন ছেড়ে দেয়নি। প্রকৃতিগতভাবে নারী কোমল ও দুর্বল। সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা ও নারীর নিরাপত্তার স্বার্থে দাম্পত্য জীবন যাপনের লক্ষ্যে ইসলাম বিয়েকে ফরজ করেছে এবং বিয়েবহির্ভূত যৌন চাহিদা পূরণের সব উপায়-উপকরণকে হারাম ঘোষণা করেছে।

নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ বলে কিছু নেই। সুখ ও দুঃখ মিলেই মানুষের জীবন। দাম্পত্য কলহ না হওয়া উত্তম এবং কলহ দেখা দিলে দ্রুত মিটিয়ে ফেলা দরকার। ইসলামে মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। স্বামী-স্ত্রী বা দু’জন মুসলিমের মধ্যে বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বে তৃতীয়জন মহিলার কাছে যদি বলে, আপু, ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল, তিনি আপনাকে খুব অনুভব করেন। আবার পুরুষটির কাছে গিয়ে বলে, আপনার জন্য আপু তো খুব পেরেশান। কী খান না খান সে চিন্তায় তো তার আহার-নিদ্রা সব বন্ধ। হয়তো বলল, তোর আপুকে বোঝায়ে বল চলে আসার জন্য। এ মিথ্যা মিথ্যা নয়। এটি সওয়াবের। মানবতার ধর্ম, ফিতরাতের ধর্ম ইসলাম সব মানুষের শুধুই কল্যাণ চায়।

স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদাকে ইসলাম অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। স্ত্রীর মোহরানা ও তার উপার্জনের ওপর তাকে কর্তৃত্ব দান করা হয়েছে। সে তার অর্থ সংসারে খরচ করতে বাধ্য নয়। সংসারে তার খরচ সদকা এবং সে প্রভূত সওয়াবের অংশীদার হয়। সংসারে নারীর কাজটিকে খেদমত হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় এবং তাতে সে প্রভূত নেকির অধিকারী হয়।

হজরত আলী রা: ও ফাতেমা রা. ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। নিজ হাতে যাঁতা পিষতে গিয়ে ফাতিমা রা:-এর হাতে ফোঁসকা পড়ে যায়। তিনি তার পিতার কাছে এসে একটি দাসী চান। রাসূল সা. দাসী না দিয়ে অধিক সওয়াবের সুসংবাদ শোনাতে গিয়ে ফরজ নামাজ শেষে ৩৩ বার ছোবহান আল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়তে বলেন। এই আচরণের মাধ্যমে তিনি তাঁর কলিজার টুকরো মেয়েকে ঘর-সংসারের কাজ করার মর্যাদাও বুঝিয়ে দেন।

হজরত ওমর রা:-এর স্ত্রী ছিলেন খুবই তেজস্বী। তিনি নিয়মিত নামাজের জামাতে উপস্থিত হতেন। ওমর রা. চাইতেন ঘরে আদায় করতে, আবার স্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে নিষেধও করতে পারতেন না। তার স্ত্রী বলতেন, তুমি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি যেতেই থাকব। যেহেতু রাসূল সা: বলেন, আল্লাহর কোনো বান্দি মসজিদে আসতে চাইলে তাকে বাধা দিও না। ওমর রা: আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর হুকুম পালনে ছিলেন আপসহীন। ফলে তিনি নিজের পছন্দকে কখনোই অগ্রাধিকার দিতে পারেননি।

জনৈক সাহাবি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ঝগড়া করার অভিযোগ নিয়ে খলিফা ওমর রা:-এর কাছে আসেন। আসার পর তিনি খলিফার ঘরে জোরে আওয়াজ শুনেন। উনি তখন ভাবেন, তার চেয়ে খলিফা আরো বেশি অসহায়। তিনি ফিরে যেতে উদ্যত হন। এমন সময় খলিফা বেরিয়ে এসে সাক্ষাতের কারণ জানতে চান। সাহাবির অভিযোগ শোনার পর ওমর রা. বলেন, দেখো, আমাদের স্ত্রীরা কত খেদমত করে থাকেন। সন্তানদের লালন-পালন, দুগ্ধপানসহ সংসারের যাবতীয় কার্য সম্পাদন করেন, তাদের একটু কটু কথা শুনতেই হয়। তিনি বলেন, ধৈর্যধারণ ও মিলেমিশে চলার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ। সঙ্কীর্ণতা নয়, উদারতা ও প্রশস্ততার মধ্যেই রয়েছে দাম্পত্য জীবনে সুখ, শান্তি ও কল্যাণ।

কুরআন মজিদে আমাদের সম্মুখে কিছু দম্পতির উদাহরণ পেশ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ছিল কলহ বিবাদ এবং একে অপর থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। হজরত লুত আ. ছিলেন আল্লাহর একজন নবী অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নবী হিসেবে স্বামীকে অস্বীকারকারী। অথচ আল্লাহর গজব আসার আগ পর্যন্ত স্ত্রীকে সৎপথে আনার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ঠিক বিপরীত ফিরাউনের স্ত্রী আছিয়া ছিলেন নবী মূসা আ.-এর অনুসারী একজন খাঁটি মুসলিম। আছিয়া ঈমান গোপন রেখে ফেরাউনের সাথে জীবনযাপন করেছেন। অবশেষে শাহাদত বরণ করেছেন। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পারিবারিক জীবন বজায় রেখেছেন। নূহ আ.-এর ঘটনাও তাই। তাঁকে নবী হিসেবে অস্বীকারকারী সন্তানকে ত্যাগ করেননি। ত্যাগ করলে সংশোধনের রাস্তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত।

পারস্পরিক সম্পর্ক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর বান্দার মাঝে উদারতা দেখতে চান। এ প্রসঙ্গে সূরা তাগাবুনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কতিপয় শত্রু। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো। আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়ালু।

এমন অনেক স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়েছে যারা তাদের স্বামী বা পিতার হালাল রুজিতে সন্তুষ্ট নয়; আবার এমন কপালপোড়া স্বামীও আছে যারা স্ত্রীর পর্দায় চলা পছন্দ করে না। এদেরকে আল্লাহপাক শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দাম্পত্য বা পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হোক এমনটি আল্লাহ চান না। বরং আল্লাহ চান স্বামী-স্ত্রী পরস্পর উদার, সহনশীল ও ক্ষমার নীতি অবলম্বন করুক। তার বিনিময়ে আল্লাহকেও ক্ষমাশীল ও দয়ার্দ পাবে।

নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবনটাকে সুখি, সুন্দর ও তৃপ্তিদায়ক করার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের সবারই আন্তরিক হওয়া দরকার। পরস্পর দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা অর্থাৎ সবারই ছাড় দেয়ার মনোবৃত্তি থাকতে হবে। অনমনীয় মনোভাব সংসারে সমস্যার সৃষ্টি করে। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর সদাচরণ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আল্লাহর হক পালনের সাথে সাথে স্ত্রীর ওপর স্বামীর সন্তুষ্টি প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, জান্নাতের যে দরজা দিয়ে খুশি স্ত্রী প্রবেশ করতে পারবে। আল্লাহপাক আমাদের পরিবারগুলোকে শান্তির নীড় করে দিক। সন্তান-সন্তুতি দ্বারা তিনি আমাদের চোখকে শীতল করে দিন। আমীন।

লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ

You may also like