Home রাজনীতি দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বর্ণাঢ্য জীবন

দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের বর্ণাঢ্য জীবন

by Newsroom
দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

ঢাকা: অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন একজন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। যিনি ছিলেন মুজিব আদর্শের নির্ভীক সৈনিক ও নিবেদিত প্রাণ। যার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বড় একটি ইতিহাস। তিনি দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। সাহারা খাতুন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আজীবন আস্থাশীল ছিলেন। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বহুবার নির্যাতিত হয়েছেন ছিলেন কারাগারের অন্ধকারে।
রাজনৈতিক এ সংগঠক ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায় পিত্রালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের সর্বশেষ সময়টুকো তিনি ফার্মগেটের ৩৪, এয়ারপোর্ট রোড, তেজগাঁও-এ বসবাস করতেন। পিতা মরহুম ডা. আবদুল আজিজ মাস্টার ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক।

শিক্ষা জীবন

কুর্মিটোলা হাইস্কুলে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর তাকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। সেখানে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলে ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৯৬০ সালে ইস্ট-পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তিনি সিটি নাইট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে পাস করে জগন্নাথ কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন। বি.এ (ফাইনাল) পরীক্ষার সময় অসুস্থ থাকায় এক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে চাচা মরহুম আবুল হাশেমের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি.এ (ডিগ্রি) অর্জন করেন।

তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা আসেন এবং রাজনীতিতে যুক্ত হন । পরে পুনরায় করাচি  থেকে রেজাল্ট নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ছাত্রদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। সেটি ছিলো তার জীবনের প্রথম নির্বাচন। এরপরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এত বেশি জড়িয়ে পড়েন যে আর ‘আইন বিষয়ে’ পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যার প্রতিবাদের ৪ নভেম্বর তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩২নং ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত মিছিল হয়েছিলো । পরের দিন  চার নেতার লাশ পাওয়া যায়। ঠিক ওই দিনই সাহারা খাতুনের  ‘ল’  একটি বিষয়ে পরীক্ষা ছিলো। তিনি তখন ভাবলেন পরীক্ষা পরেও দেয়া যাবে কিন্তু জাতীয় নেতাদের শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। এ কারণে সে বৎসর আর পরীক্ষা দেননি তিনি। এর পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ল’ (অনার্স) কোর্স শুরু হয়। তখন শিক্ষকদের পরামর্শে বিজয়নগরে সেন্ট্রাল ‘ল’ কলেজে ভর্তি হন তিনি। আইন পেশায় আসার অদম্য ইচ্ছায় সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২য় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইনপেশা পরিচালনার সনদপ্রাপ্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমানের জুনিয়র হিসেবে আইনপেশা শুরু করেন ।

ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে সনদ পান ও আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। তিনি পরবর্তীতে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত এবং বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৬ দফা আন্দোলন

১৯৬৬ সালে তিনি ৬ দফার আন্দোলনে অংশনেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৬ দফার বই বিলি করেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হলো তাতে তিনি সক্রিয় অংশ নেন এবং ঢাকা শহরে মহিলাদেরকে প্রয়াত আইভি রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করেন। তখন থেকেই মিটিং মিছিল সবকিছুতেই অংশ গ্রহণ করেছেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখনকার ছাত্রলীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দিন তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার অনেক নারী নেতাকর্মীদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন।

আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেয়া হলে তিনি সে মামলা আইনজীবীদের নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অধিকাংশ নেতাকর্মীর মামলা পরিচালনা করেন। আহত কর্মীদের হাসপাতালে এবং বাসায় দেখতে যেতেন। বিশেষ করে নারী কর্মীদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিলে তাদেরকে যাতে নির্যাতন করা না হয় সেজন্য আইনজীবীদের নিয়ে থানায় যেতেন। পরিবারকে সান্তনা দিতে বাসায় ছুটতেন।

২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের  মামলাগুলোতে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, রহমত আলী, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, মো. মোখলেছুর রহমান বাদল ও আবদুর রহমান হাওলাদারসহ অনেকের সঙ্গে তিনিও পরিচালনা করেছেন। তিনি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও শেখ হাসিনা এবং নেতাকর্মীদের জন্য সাংবাদিকদের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন।

জাতীয় নির্বাচন

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা-৫ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরে একই আসনে খালেদা জিয়া সিট ছেড়ে দিলে শূন্য আসনের উপ-নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি।

এর পর তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে চ্যালেঞ্জিং মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেদিন যুক্ত হয়েছিল প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সফলতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরে পৌনে চার বছরের মাথায় তাকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি পুনরায় ঢাকা-১৮ আসন থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

রাজনৈতিক জীবন

রাজনৈতিক জীবনে তিনি নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে মহিলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক, পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদিকা এবং একই সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদক, পরে আইন সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদকের পদ গ্রহণ করেননি।

তিনি পরবর্তী কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। আমৃত্যু পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি মহিলা সমিতির সদস্য মনোনিত হন। তখন আইভি রহমান মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ড. নীলিমা ইব্রাহিম সভানেত্রী ছিলেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য, ঢাকা আইনজীবী সমিতির আজীবন সদস্য, গাজীপুর আইনজীবী সমিতির আজীবন সদস্য, ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়শনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যশানাল এলাইন্স অব ওমেন্সের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই খ্যতিমান রাজনীতিক ৬ জুন শনিবার জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ৭ জুলাই থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুইদিন ভর্তি থাকার পর বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ভয়েসটিভি/প্রতিবেদক/ডিএইচ

You may also like