Home প্রযুক্তি নিউক্লিয়ার ফিউশনে শক্তি উৎপাদনে বড় সাফল্য

নিউক্লিয়ার ফিউশনে শক্তি উৎপাদনে বড় সাফল্য

by Mesbah Mukul

নিউক্লিয়ার ফিউশন নামের যে প্রক্রিয়ায় সূর্যের মত নক্ষত্রে শক্তি তৈরি হয়, পৃথিবীতে সেই প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের চেষ্টায় বড় ধরনের সাফল্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইউরোপীয় গবেষকরা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস (জেইটি) ল্যাবরেটরির গবেষকরা বলছেন, হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটপ ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তারা তাপ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়েছেন।

বিবিসি লিখেছে, সত্যি সত্যি যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তিজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না।

জেইটি ল্যাবের গবেষকরা তাদের এবারের গবেষণায় ৫ সেকেন্ডে ৫৯ মেগাজুল (১১ মেগাওয়াট) শক্তি তৈরি করতে পেরেছেন, যা ১৯৯৭ সালে তাদের একই ধরনের গবেষণায় উৎপাদিত শক্তির দ্বিগুণেরও বেশি।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের গবেষণায় যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা গেছে, তা দিয়ে ৬০ কেটলি পানি গরম করা যাবে। সেই অর্থে এটা অনেক বড় পরিমাণ শক্তি হয়ত নয়, তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিজ্ঞানীরা একটি কৌশল উদ্ভাবন করতে পেরেছেন, যা দিয়ে আরও বড় আকারের ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরি করা যাবে।

রিঅ্যাক্টর ল্যাবের হেড অব অপারেশনস ড. জো মিলনেস বলেন, “জেইটির এই গবেষণা আমাদের ফিউশন পাওয়ারের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিল। এ গবেষণায় আমরা এটাই দেখাতে পেরেছি যে, আমাদের যন্ত্রের মধ্যে আমরা অতি ক্ষুদ্র একটি নক্ষত্রের জন্ম দিতে পেরেছি এবং ৫ মিনিট সেটাকে ধরে রাখতে পেরেছি। এখানে যে পারফরম্যান্স আমরা দেখাতে পেরেছি, তা আমাদের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে।”

আরও পড়ুন : সাংবাদিক-সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে : তথ্যমন্ত্রী

জেইটি ল্যাবরেটরির এ গবেষণা চলছে ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টরের (আইটিইআর) কর্মসূচির অধীনে। দক্ষিণ ফ্রান্সে ওই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের গবেষণা এগিয়ে নিতে সমর্থন দিচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশের একটি কনসোর্টিয়াম, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনও রয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, এই শতকের দ্বিতীয় ভাগেই নিউক্লিয়ার ফিউশন একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হয়ে উঠতে পারে, এই গবেষণার সাফল্য হয়ত সেটাই প্রমাণ করল।

ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদুৎকেন্দ্র তৈরি করলে তাতে গ্রিনহাউস গাস নির্গমণ হবে না। স্বল্পস্থায়ী তিজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হলেও তার পরিমাণ হবে খুবই সামান্য।

জেইটি ল্যাবরেটরির সিইও অধাপক ইয়ান চ্যাপমান বলেন, “যে গবেষণা আমরা শেষ করলাম, তা বাস্তবেও কাজ করার কথা। যদি তা কাজ না করে, তাহলে আইটিইআর লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন উঠবে।”

নিউক্লিয়ার ফিউশন কী?

কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে ভিন্ন মৌলের একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস তৈরি হলে কিংবা উল্টোভাবে একাধিক পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে কোনো ভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি করলে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিকিরণ ঘটে, যাকে বলে পারমাণবিক শক্তি।

এটা ঘটতে পারে দুই ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে। একটিকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন, অন্যটি নিউক্লিয়ার ফিউশন।

ফিশন বিক্রিয়ায় একটি ভারী মৌলের পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয়। তাতে ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি হাল্কা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয়। তাতে নির্গত হয় বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক শক্তি।

এভাবে পারমাণবিক শক্তি তৈরির কৌশল মানুষ আয়ত্ত করেছে আগেই। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর পারমাণবিক বোমা এই প্রক্রিয়ারই ফল।

এ বিক্রিয়ার সময় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস যখন ভেঙে যায়, তখন তিনটি নিউট্রনও উৎপন্ন হয়। সেই তিনটি নিউট্রন তখন আরও তিনটি নিউক্লিয়াসে আঘাত করে নতুন তিনটি বিক্রিয়ার সূচনা করে। তাতে পাওয়া যায় আরও শক্তি এবং নয়টি নিউট্রন।

তত্ত্বীয়ভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হলে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে, সেজন্য একে বলে চেইন রিঅ্যাকশন। এই চেইন রিঅ্যাকশন অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকলে বিপজ্জনক পরিমাণ তাপ বিকরিত হয়। এই মূলনীতিতেই তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা।

কিন্তু চেইন রিঅ্যাকশনের সময় তৈরি হওয়া প্রতি তিনটি নিউট্রনের মধ্যে দুটি যদি শোষণ করার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই ফিশন বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তখন বিপদ না ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তাপ উৎপাদন করা যায়। এই কৌশল ব্যবহার করেই তৈরি হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম পরমাণুকে একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে এর ফিশন ঘটানো হয়। সমস্যা হল, এর জ্বালানি সহজলভ্য নয় এবং এ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়।

নিউক্লিয়ার ফিউশনের সূচনা হয় ফিশন বিক্রিয়ার উল্টো প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে দুটি বা তার বেশি নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে এক বা একাধিক ভিন্ন মৌলের পরমাণু তৈরি করে, সঙ্গে পাওয়া যায় বিপুল শক্তি।

যেমন হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। সেই সাথে মুক্ত হয় একটি নিউট্রন। সূর্যে প্রচণ্ড মধ্যাকর্ষণের চাপের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশনেই ক্রমাগত শক্তি তৈরি হচ্ছে। সেখানে মোটামুটি ১ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ওই বিক্রিয়া ঘটছে।

কিন্তু পৃথিবীতে ওই মাত্রায় চাপ তৈরি করা সম্ভব না। ফলে যদি ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে হয়, তাহলে তাপমাত্রা বাড়িয়ে মোটামুটি ১০ কোটি সেলিসিয়াসে নিতে হবে।

পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই, যেটা ওই তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে। ফলে ল্যাবরেটরিতে এ গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস বা প্লাজমাকে তারা শূন্যে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে।

অক্সফোর্ডশায়ারে কুলহ্যামে জেইটির এই ল্যাবে ফিউশন বিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চলছে মোটামুটি ৪০ বছর ধরে। এর মধ্যে গত দশ বছর ধরে তারা আইটিইআর এর কৌশল অনুসরণ করে কাজ করছে।

এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, পুরো প্রক্রিয়া শুরুর জন্য তার চেয়ে বহু গুণ বেশি শক্তি খরচ করতে হচ্ছে।

যেমন জেইটির এবারের গবেষণার জন্য দুটো ৫০০ মেগাওয়াটের ফ্লাইহুইল চালাতে হয়েছে, আর ফিউশনে তৈরি হয়েছে ১১ মেগাওয়াট শক্তি।

তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, বড় পরিসরে প্লাজমার পরিমাণ বাড়িয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো গেলে খরচ করা শক্তির চেয়ে বেশিই উৎপাদন করা সম্ভব।

তবে সেজন্য যেতে হবে আরও বহু পথ, দরকার হবে আরও অনেক গবেষণা, তাতে লাগবে আরও অনেক সময়।

বিবিসি লিখেছে, জেইটি ল্যাবকে আগামী বছরই অবসরে পাঠানো হবে। এরপর ২০২৫ সাল থেকে প্লাজমা নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা শুরু হবে ফ্রান্সের আইটিইআর ল্যাবে।

সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ভয়েসটিভি/এমএম

You may also like