Home সারাদেশ ডিসির প্রকাশ্যে গণশুনানি, মিলছে হাজারো সমস্যার সমধান

ডিসির প্রকাশ্যে গণশুনানি, মিলছে হাজারো সমস্যার সমধান

by Newsroom
প্রকাশ্যে গণশুনানি

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার যোগদানের পর থেকেই সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে জেলা প্রশাসক শুরু করেছেন প্রকাশ্যে গণশুনানি। নিজের অফিস কক্ষের বাইরে খোলা জায়গায় গণ শুনানিতে সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা শুনে সমাধানের পথ বাতলে দিয়ে সাধারণ মানুষের আপনজনে পরিণত হয়েছেন তিনি। আর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে সমস্যার সমাধান মিলছে জেলার হাজারো মানুষের।

এছাড়া তাঁর অফিসে গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক, একজন মুটে-মজুর গেলেও তার সাথে হাসিমুখে কথা বলে তিনি সর্ব মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ফরিদপুরে যোগদানের পর থেকে একের পর এক ব্যতিক্রমী চিন্তা চেতনায় আকৃষ্ট করলেও এবার এক অকল্পনীয় ও অভাবনীয় নজির স্থাপন করেছেন এই জেলা প্রশাসক। সপ্তাহের বুধবার বেশি সময় নিয়ে প্রকাশ্যে তিনি সাধারণ মানুষের কথা শুনেন এবং তাৎক্ষনিক সমাধানের চেষ্টা করেন।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের প্রকাশ্যে গণশুনানিতে এবার পড়ালেখা অব্যহত রাখার জন্য বই পেয়েছে সাদিয়া। ২৫ নভেম্বর বুধবার বিকেলে সাদিয়াকে বই তুলে দেন জেলা প্রশাসক।

জেলার মধুখালী উপজেলার সরকারি আইনউদ্দিন কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম মৌ। এ বছরের শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। পিতা রাজু আহমেদ অসুস্থ। কোন উপার্জন নাই। মা হাসিয়া বেগম টিউশনি করে কোন মতে সংসার চালান। কিন্তু বিশ্ব মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে হাসিয়া বেগমের টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়।

প্রথমে হাতে জমানো কিছু টাকা দিয়ে কোন রকমে সংসার চললেও পরে আর চালাতে পারছিল না। এ পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়ে যায় সাদিয়া। ক্লাসের অন্যান্যরা বই কিনে বাসায় বসে পড়ালেখা শুরু করলেও ওর (সাদিয়া) পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।

এভাবে কেটে যায় ৩ মাস। অর্থাভাবে বই না কিনে বাসায়ই বসে থাকে। এরই মাঝে হঠাৎ প্রতিবেশির মাধ্যমে জানতে পারে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার প্রতি বুধবার নিজ কার্যালয়ের অফিস কক্ষের সামনে প্রকাশ্যে গণশুনানি করেন। এ সময় জনগণের সমস্যার যথাযথ প্রমান পেলে জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন বলেও সাদিয়া জানতে পারে।

প্রতিবেশীর কথা অনুযায়ী ২৫ নভেম্বর বুধবার সকালেই সাদিয়া আর তার মা চলে আসে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। সকাল ১০ টায় শুরু হয় গণশুনানি। সাদিয়া আর তার মা অর্থাভাবে বই না কিনতে পারার কথা জানান।

জেলা প্রশাসক অতুল সরকার ঘটনার সত্যতা পেয়ে তাৎক্ষণিক বাজার থেকে সাদিয়া ইসলাম মৌ এর জন্য বই কিনে তার হাতে তুলে দেন।

বই পেয়ে সাদিয়া তার অনুভ‚তি প্রকাশ করতে বলে, ‘ডিসি স্যার আমার খুব উপকার করলেন। তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। সাদিয়া আরো বলে, আমি কিছু কিছু বিষয়ে দুর্বল। এবার বই পেয়ে আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বাত্মক ভাল রেজাল্ট করার চেষ্টা করবো।’

এদিকে জেলার সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের পিয়াজখালী এলাকার বাসিন্দা পলাশী বেগম। পলাশী বেগমের দুই সন্তান। ৬ বছর বয়সী মেয়ে মিতু আর ৪ বছর বয়সী ছেলে নাহিদ। মিতু আর নাহিদ মায়ের পিছনে পিছনে ঘুরে দিনের কোন বেলায় আধপেট আবার কোন বেলায় উপোষ ই কাটাতে হয়। আর খাবার পাবেই কিভাবে, ওদের মা পলাশী বেগম এর ওর বাড়ি কাজ করে, যা পায় তা দিয়ে তিন বেলার আহার জোটানো কষ্ঠ সাধ্য। খাবার প্রাপ্তিই যেখানে কষ্ঠসাধ্য সেখানে পোষাকের কথা দুঃসাধ্য। আর শিক্ষা? সেটা ওদের জন্য সুদূর পরাহত। যেখানে খাবার জোগানোর সামর্থ নাই, পোষাক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নাই, সেখানে শিক্ষার ব্যবস্থা কে ই বা করবে ওদের। এমন নানাবিধ মৌল মানবিক অভাবের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত হচ্ছিল ওদের।

ঠিক এমনই একটা সময় ওরা সন্ধান পায় জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের। লোক মাধ্যমে শুনতে পায় জেলা প্রশাসক অতুল সরকার সাধারণ মানুষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকেন। তবে সপ্তাহের বুধবার দিন বেশি সময় নিয়ে তিনি সাধারণের কথা শুনেন। শোনা কথায় বিশ্বাস করে পলাশী বেগম ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের পিয়াজখালী এলাকার চাকলাদার গ্রাম থেকে ছুটে আসেন জেলা প্রশাসকের দ্বারে। পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা বেলা গড়িয়ে যায়।

পলাশী বেগম দেখেন অফিসের দো-তলায় ফাকা জায়গায় অনেক লোক। কেউ বা বসে আছে চেয়ারে, কেউবা দাড়িয়ে। সকলের সামনে একজন লোক বসা। পলাশী ওখানকার একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভাই, এ অফিসে ডিসি কিরা?’ লোকটা তাকে দেখিয়ে দেয়, লোকজনের সামনে বসে থাকা লোকটাকে। এগিয়ে যান পলাশী। দেখেন তার সামনে একে একে লোকজন তাদের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। একজন বয়স্ক ব্যক্তির থাকার ঘর না থাকার কথা জানালেন। সাথে সাথে তার নিজের কোন জমিজমাও নাই, জানালেন। জেলা প্রশাসক তার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন দিয়ে যাচাইপূর্বক তাকে আশ্রয় কেন্দ্রে ১ টি ঘর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। অন্য ব্যক্তি এসেছেন তার বাড়িতে বার্ষিক উরশ হবে তার অনুমোদন ও কিছু অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য।

পলাশী বেগম নতুন এসেছেন। তাই অনেকটা ইতস্তত করছিল তার মনটা। কিভাবে কথা বলবেন। আরও একটু ধৈর্য্য ধরে দেখতে থাকলেন কে কি বলে। দেখলেন, এক ব্যক্তি ভাল পোষাক পড়া, সে তার বাড়ির জমি জমা নিয়ে প্রতিবেশির সাথে ঝামেলার কথা জানালো। জেলা প্রশাসক সাথে সাথে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বললেন। অন্য একজন মুরুব্বী টাইপের মহিলা জানালেন তার বাড়িতে ঘর নাই। এক চিলতে ছনের ঘর ছিল। বহু বছরের পুরাতন। এখন সে ঘর দিয়ে পানি পড়ে। তার ঘর দরকার। জেলা প্রশাসক তাকে সরকারি টিন প্রদানের জন্য জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন।

বাড়ির পাশে কিছু বখাটে রাত অবধি আড্ডা দেয়, একজনের অভিযোগ পেয়ে সেখানে আইনগত সহায়তার পরামর্শ দিলেন জেলা প্রশাসক। জেলা সদরের ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের দশম শ্রেণির ছাত্রী চাদঁনী আক্তার। গত কয়েক মাস ধরে স্কুলের বেতন ও টিউশন ফি দিতে পারছিলেন না। জেলা প্রশাসক ধৈর্য্য ধরে তার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাকে নগদ অর্থ সাহায্য ছাড়াও তার পড়াশুনার খরচ বহন করার কথা জানান। এবার পলাশী বেগম অনেক টা সাহস সঞ্চার করে নিজের সমস্যার কথাটা জানালেন।

পলাশী জানালেন, ৮/৯ বছর আগে সদরপুর উপজেলার আটরশি স্ট্যান্ডের পাশে রব মাতুব্বরের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের এক সন্তান হয়। নাম রাখে মিতু। কিছুদিন পর থেকে স্বামীর আচরণ বদলে যায়। কারনে অকারনে তাকে মারধর করতে থাকে। এ সময় পলাশী জানতে পারে তার স্বামী আগেও একটা বিয়ে করেছিল। তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। এখন আবার তাকে নিয়ে সংসার করবে। এক সময় পলাশীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কয়েক বছর পরে আবার আগের বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়। এ সময় পলাশীকে আবার ঘরে তুলে, তাদের এবার একটি পুত্র সন্তান হয়। নাম রাখে নাহিদ। কিছুদিন পরে আবার তার স্বামী পূর্বের বউকে নিয়ে আসে। ওদের বাড়ি থেকে আবার তাড়ায়।

এবার পলাশী পড়ে মহা বিপদে। একটি মেয়ে একটি ছেলে নিয়ে কিভাবে বাঁচবে? মানুষের বাড়িতে কাজ করা শুরু করে। নিজেতো নয়ই বাচ্চাদেরও কোন দিন পেট পুড়ে খেতে দিতে পারে না। পলাশীর মেয়ের বয়সী সবাই স্কুলে গেলেও তার মেয়ে মিতুকে স্কুলে দিতে পারেনি। ছোট ছেলেটা এখনো স্কুলে যাবার বয়স হয়নি।

জেলা প্রশাসক মন দিয়ে তার কথা শুনেন। মেয়ে মিতু (৭)কে সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) তে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ছেলে নাহিদের (৪) বয়স হলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবেন। এই দু জনের পড়ালেখার জন্য তিনি নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভবিষ্যতে যেকোন প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। একই সাথে ওদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে দেন।

প্রতিবেদকের নিকট পলাশী বেগম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আল্লা আমারে বাঁচাইছে। ডিসি স্যার সব দায়িত্ব নিছে। এখন খাই না খাই পোলাপানের নিয়ে আর কোন চিন্তা নাই। আল্লা ডিসিরে হায়াত দিক; দোয়া করি।

প্রকাশ্যে গণশুনানির আয়োজনের মাধ্যমে শুধু পলাশী বেগমই নয় বদলে যাচ্ছে হাজারো মানুষের জীবন। গড়ে উঠছে সম্ভাবনা। পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের। সমাধান হচ্ছে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার।

প্রকাশ্যে গণশুনানির বিষয়ে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, একটা সময় অফিস কক্ষে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হত। এ শুনানিতে জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা রকমের লোকজন আসতেন। এদের কেউ অল্প বয়সী, কেউ বয়প্রকাশ্যে গণশুনানিষ্ক।

 

তিনি বলেন, অফিস কক্ষের মধ্যে ছিমছাম পরিবেশে অনেকেই কথা বলতে সংকোচ করতেন, কেউ কেউ তাদের সকল সমস্যা খুলে বলতে পারতেন না। এখন প্রকাশ্যে গণশুনানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে সংকোচটা আর থাকছে না। সকলে তাদের মনের কথা খুলে বলছেন।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সুশাসনে গড়ি, সোনার বাংলা’ এই শ্লোগানে আমরা কাজ করছি। চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের কথা শুনে তাদের সেবা দিতে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, গত এক বছরে গণশুনানিতে প্রায় ৫ হাজার জন সেবা প্রত্যাশী জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে এই চলমান মাসে প্রায় ৪শ ৫৩ জন, গত অক্টোবর মাসে ৪শ ২৭ জন সেবা প্রত্যাশী সাক্ষাৎ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে ৩শ ৫২ জন; আগস্ট মাসে ১শ ৪২ জন সেবা প্রত্যাশী সাক্ষাৎ করেন।

প্রকাশ্যে গণশুনানি

মূলত, জমির একসনা বন্দোবস্ত প্রাপ্তি, আইনগত সহায়তা, আর্থিক সাহায্য, টিআর, জিআর. সরকারি ঢেউটিন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রাপ্তি, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তি, বিধবা ভাতা প্রাপ্তি, বাল্য বিবাহ রোধ, জমিজমা বিরোধ সংক্রান্ত, ঘর মেরামত, পড়ালেখার খরচ চালানো, শীতের পোষাক প্রাপ্তি, ধর্মীয় কার্যাদিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলার নাগরিকগণ জেলা প্রশাসককে জানান।

জেলা প্রশাসক সেসব সমস্যা সমাধান করে থাকেন। সাধারণত প্রতিদিনই জেলা প্রশাসক জনসাধারণের কথা শুনে থাকেন। তবে বিশেষভাবে প্রতি বুধবার দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রকাশ্যে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন- বিস্ফোরণের ঘটনায় চলছে গণশুনানি

ভয়েস টিভি/ডিএইচ

You may also like