রাজধানীর গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে পৌঁছানোর ঠিক আগে গ্লোরা বাসস্ট্যান্ড হয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার উত্তরে বালিয়াটি জমিদার বাড়ির অবস্থান।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সবসময় যানবাহনের চাপ থাকলেও দু’পাশ কিন্তু বেশ সুন্দর। শুধু সবুজ আর সবুজ। কখনও মনে হতে পারে যেন সবুজের আল্পনা অঁকে রেখেছে কেউ।
দূরে গ্রাম আর মাঠের পর মাঠ জুড়ে ফসলের ক্ষেত। কোথাও আবার ডোবা-নালা। একদিন একটু ইচ্ছে হলে যে কেউই গ্রামীণ আমেজ পেতে এই মহাসড়ক ধরে লং ড্রাইভে যেতে পারেন। চোখ জুড়ানো সবুজ দেখতে পাবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেইসঙ্গে কিছু মনোরম দৃশ্য যে বিশেষভাবে নজর কাড়বে না। তা একদমই বলা যাবে না।
বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে রয়েছে মোট সাতটি স্থাপনা। এই জমিদার বাড়ি বা প্রাসাদটির সবগুলো ভবন একসঙ্গে স্থাপিত হয়নি। বিভিন্ন ভবন জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারীকারীরা বিভিন্ন সময়ে স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্লকটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই প্রাসাদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ও পরিচালিত হচ্ছে। উনিশ শতকের এই ইমারত ঔপনিবেশিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। ১৯৮৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর বালিয়াটি প্রাসাদ সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- একটি নিম্নবিত্ত সাহা পরিবার থেকেই পরবর্তীতে বালিয়াটি জমিদার বংশের উদ্ভব হয়েছিলো। এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি। দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি বেশ পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের ঢল নামে এই জমিদার বাড়িতে। দূর-দূরান্ত থেকে আসেন দর্শনার্থীরা।
বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে আছে দৃষ্টিনন্দন ইমারত, নির্মাণ কৌশল আর নানা অলংকরণ। জমিদার আমলের বিশাল বিশাল ভবনগুলো জমিদারদের বিত্ত বৈভবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ঝড়-তুফান, বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি। জমিদার বাড়ির সিংহ দরজায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে প্রশস্ত আঙিনা। একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে চারটি বহুতল ভবন। এগুলোর পেছনে রয়েছে অন্দরমহল এবং বেশ কয়েকটি বড়-বড় পুকুর। জমিদার বাড়ির ভেতরের রং মহল খ্যাত ভবনটি এখন জাদুঘর। পুরো জমিদার বাড়ির চত্বরটি উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রাসাদের ২০০ কক্ষের প্রতিটিতেই রয়েছে প্রাচীন শিল্পের সুনিপুণ কারুকাজ। প্রাসাদ চত্বরটি প্রায় ১৬ হাজার ৫৫৪ বর্গমিটার জমির ওপর ছড়িয়ে থাকা সাতটি দালানের সমাবেশ। প্রতিটি দালানই ঊনবিংশ শতকে নির্মিত। জমিদার বাড়ির চারটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। প্রতিটি প্রবেশ দ্বারের উপর রয়েছে একটি করে তেজী সিংহের পাথরের মূর্তি।
বর্তমানে জমিদার বাড়ির প্রশস্ত আঙিনাজুড়ে রয়েছে ফুলের বাগান। আর পুকুরের চারপাশে রয়েছে চারটি শান বাঁধানো নান্দনিক ঘাট। বাড়ির প্রতিটি দেয়াল ২০ ইঞ্চি পুরু। গাঁথুনিতে সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে চুন-সুরকি আর শক্তিশালী কাদামাটি। লোহার রডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে লোহার পাত। ভেতরে রয়েছে লোহার সিঁড়ি। ধারণা করা হয়, সামনের চারটি প্রাসাদ ব্যবসায়ী কাজে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া, অন্দরমহলে গোবিন্দরাম পরিবার বসবাস করতেন বলে জানা গেছে।
বালিয়াটি প্রাসাদটি স্থাপত্য কৌশলের অন্যতম নিদর্শন। সুবিশাল এই প্রাসাদ পাঁচটি স্বতন্ত্র ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত। যার মধ্যে পূর্বদিকের একটি ব্লক ছাড়া চারটি ব্লকের দুটিতে একটি দ্বিতল ভবন এবং একটি টানা বারান্দা বিশিষ্ট ত্রিতল ভবন রয়েছে। প্রাসাদটির পেছনে রয়েছে অন্দরমহল। উত্তরদিকের ভবনটি কাঠের কারুকার্যে তৈরি। সুবিশাল প্রাসাদটির চারপাশেই সু-উচ্চ দেয়াল রয়েছে। প্রতিটি অর্ধ-বৃত্তাকার খিলান আকৃতির রয়েছে সিংহ খোদাই করা তোরণ।
জমিদার বাড়িটির ঐতিহ্য শুরু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। আর এই গোলাবাড়িটি লবণের একটি বিশাল গোলা ছিল বলেই ধারণা করা হয়। জমিদাররা ধর্মপ্রাণ হওয়ায় বাড়ির মন্দিরে পূজা অর্চনা করা হতো।
১৮৮৪ সালে বালিয়াটি জমিদারের উত্তরাধিকার জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন- বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজ।
জমিদার বাড়ির পশ্চিম অংশকে পশ্চিম বাড়ি এবং পূর্ব অংশ পূর্ববাড়ি বলেও নামকরণ রয়েছে। এ বাড়ির প্রথম জমিদার পুরুষ রায় চাঁন। তিনি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সম্পত্তির দশ আনা অংশ এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের দান করেন ছয় আনা অংশ। দশ আনার জমিদার বাড়িটিই বর্তমানে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান। এখানে পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত চারটি সু-বৃহৎ অট্টালিকা রয়েছে। এগুলো বড় তরফ, মেঝো তরফ, নয়া তরফ এবং ছোট তরফ নামেও পরিচিত। তবে ছয় আনার জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি রোববার পূর্ণদিবস ও সোমবার অর্ধদিবসসহ সরকারি ছুটির দিনসহ ঈদের পর দিন এই প্রাসাদ বন্ধ রাখা হয়। বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা আছে। এরমধ্যে দেশি, বিদেশি এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশ মূল্য।
ভয়েসটিভি/এএস