Home সারাদেশ ‘বউ বাজার’ থেকেই স্বাবলম্বী বহু নারী

‘বউ বাজার’ থেকেই স্বাবলম্বী বহু নারী

by Newsroom

ময়মনসিংহের কৃষ্টপুর এলাকায় দুই কলোনি ঘিরে ৩০ বছর আগে ঘরে উঠে ‘বউ বাজার’। এই বাজারে অসহায় বহু নারী নিজের প্রচেষ্টায় দোকান করে এখন পরিবারের আইডল।

সরেজমিনে বউ বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, এখানে বিভিন্ন বয়সী নারীরা শাক-সবজিসহ সব ধরনের কাঁচাবাজার, মুরগি ও মাছ বিক্রি করছেন। বাজারে ক্রেতাদের ভীড়। এই বাজার থেকেই নারীরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। তবে অনেক দোকানে পুরুষ বিক্রেতাও রয়েছেন।

এ বাজারের  সংগ্রামী এক নারী রত্না বেগম (৪০)। স্বামী দেলোয়ার হোসেন (৪৫) পনেরো বছর ধরে অসুস্থ। সেই থেকে খেয়ে পড়ে বাঁচতে জীবনের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন রত্না। কি করবেন কি খাবেন এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তার সীমা ছিলোনা তার।

কিন্তু গরীব ঘরে জন্ম নেয়া এই নারী থেমে যায়নি। নিজের প্রচেষ্টায় তরিতরকারি বিক্রির মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়ে সংসারের হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। সংসারে ফিরিয়ে এনেছেন সচ্ছলতা।

এ সময় কথা হয় রত্না বেগমের সাথে। তিনি ভয়েস টিভিকে জানান, এখন আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। স্বামীসহ তাদের মুখে আহার জোগাতে অনেক কষ্ট করেছি। তবে বুকে কষ্ট লাগে বড় ছেলে তালেব (২০) বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। আর ছোট ছেলে কুরবান (১৫) কিছু করেনা। পরিশ্রম করে শরীরের ঘাম ঝরানো টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।

তিনি বলেন, ‘বউ বাজার’ আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এই বাজার না থাকলে কি করতাম কি খেতাম তা কেবল মহান আল্লাহ তাআলা জানেন। প্রতিদিন শহরের গাঙ্গীনাড় পাড় সংলগ্ন কাঁচাবাজারে ভোরে গিয়ে বিভিন্ন টাটকা সবজি কিনে এখানে বিক্রি করি। প্রতিদিন কাঁচা তরিতরকারি ২ হাজার থেকে ২৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। এতে লাভ হয় পাঁচশ থেকে ছয়শত টাকা। আমার আয় করা এই টাকা দিয়েই সংসার চলে।

রন্তার পাশের দোকানেই ব্যবসা করেন বিলকিস বেগম (৫৫)। তার স্বামী বয়সের ভারে কোনো কাজ করতে পারেনা। দুই ছেলে সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার কারনে বিপথে চলে গেছে। সারাদিন ঘোরাফেরা করেই সময় পার করেন ছেলেরা। কোথায় সারাদিন সময় কাটায় তারও সন্ধান জানেনা মা। ‘বউ বাজারে’ তার ছোট্ট
দোকানের আয় থেকে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি।

‘বউ বাজারের’ ডান পাশেই রয়েছে মাছের বাজার। দেখা যায় এক মধ্যবয়সী নারী দর কষাকষি করে মাছ বিক্রি করছেন। বিভিন্ন নারী ক্রেতারা বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবার পুরুষ ক্রেতা বিক্রেতারাও রয়েছেন। মাছ বিক্রেতা ওই নারীর নাম অজুফা আক্তার (৩৫)। বাজারে তিনি সবচেয়ে বেশী মাছ বিক্রি করার জন্যে পাশেই স্বামী শাহজাহানকে (৪৫) বসিয়ে রেখেছেন।

মাছ বিক্রির সময় অজুফা আক্তারের সাথে একটু গল্প করার ফাঁকে ভয়েস টিভিকে বলেন, একসময় পরিবার নিয়ে অনেক খারাপ সময় পাড় করেছি। একমাত্র মাছ বিক্রি করে আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। ময়মনসিংহ নগরীর মেছুয়া বাজার ও শম্ভুগঞ্জ বাজার থেকে পাইকারি ধরে মাছ কিনে ‘বউ বাজারে’ বিক্রি করি। প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পারি। এতে দৈনিক লাভ হয় এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। তবে হঠাৎ ক্রেতা কম হলে সেদিন লোকসান হয়।

তার স্বামী শাহজাহান ভয়েস টিভিকে বলেন, স্থানীয় অনেক ক্রেতা এই বাজারে আসে মাছ কেনার জন্য। তবে এখানে ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। মাছের মাপ ও হিসাব যেনো ঠিকঠাক করতে পারে তাই পাশে বসে বউকে সহযোগিতার পাশাপাশি দুজন মিলেই মাছ বিক্রি করি। মাছ বিক্রির এই টাকা দিয়ে একমাত্র ছেলেকে কোরানে হাফেজ বানানোর জন্য মাদ্রাসায় পড়াচ্ছি। আর একমাত্র মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। এখন আমরা সুখী পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহে কয়েকজন নারী নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন কলোনি এলাকায় একটি বাজার শুরু করার। এখানকার স্থানীয়দের মধ্যে বেশীরভাগই অভাব অনটনের সংসার। তাই অন্য সকল বাজারের চেয়ে এখানে কম দামে বিক্রি করা হয়। সেজন্য এই বাজারটি এখনো টিকে আছে। বর্তমানে এই ‘বউ বাজারে’ ১৩০টি দোকান রয়েছে।

এদিকে এই বউ বাজারে একসাথে মুরগীর ব্যবসা করেন রাশিদা বেগম ও তার বড় বোন বানেছা বেগম। রাশিদার স্বামী মারা গেছেন আট বছর আগে। তারপর সংসারের হাল ধরতে এই বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। এখন স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। ছেলেকে ময়মনসিংহ কমার্স কলেজে পড়াচ্ছেন। তার বড় বোন বানেছা বেগমের স্বামী পনেরো বছর আগে মারা গেছে। সেই থেকেই অসহায় হয়ে পড়ে বানেছা। আর তাই বোনকেও তার মুরগীর ব্যবসায় যুক্ত করেন। এখন দু’বোন একসাথে মুরগীর ব্যবসা করে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।

ব্যাগ হাতে বাজার করতে আসা মর্জিনা ভয়েস টিভিকে বলেন, আমি সপ্তাহে চারদিন এখানে বাজার করি। অন্য বাজারের চেয়ে এখানে দাম তুলনামূলকভাবে কম। ‘বউ বাজারে’ নারী বিক্রেতা থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে বাজার করতে পারি। তবে বাজারের নামই যেহেতু ‘বউ বাজার’ সেহেতু পুরুষ বিক্রেতাদের সরিয়ে শুধু নারী বিক্রেতা বসানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় মুদি দোকানদার জাহাঙ্গীর (বউ বাজারের প্রবেশমুখে) জানান, প্রতিদিন দশটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সরগরম থাকে এই বাজার। অনেক নারীর ভাগ্য বদলে দিয়েছে ‘বউ বাজার’। এই এলাকার বহু অসহায় নারী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে।

তিনি আরও বলেন, কৃষ্টপুরের এই ‘বউ বাজার’ ছাড়াও নগরীর নাটক ঘরলেন এলাকায় ‘বউ বাজার’ রয়েছে। তবে আমাদের এই বাজার সবচেয়ে বেশী জমজমাট থাকে।

ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি শংকর সাহা ভয়েস টিভিকে বলেন, আমরা যতদুর পারি নারী উদ্যোগক্তা তৈরীতে সহায়তা করি। তবে নিজের প্রচেষ্টায় বউ বাজারে নারী বিক্রেতারা কাচাঁবাজার, মাছ, মুরগী, সুটকি বিক্রি করে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এনেছেন।

তিনি আরও বলেন, অসহায় এসব নারীদের প্রচেষ্টা দেখে বহু অসহায় নারী অনুপ্রাণিত হবে। এখানকার নারী ব্যবসায়ীরা দেখিয়ে দিয়েছে ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়’। কোনো নারীই সংসারের বোঝা নয়।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু বলেন, অসহায় অনেক নারীর ভাগ্য বদলে দিয়েছে এই বাজার। এই বাজারের মাধ্যমেই বহু পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এটি ছাড়াও সিটি করপোরেশন এলাকার বাজারগুলোকে উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

ভয়েস টিভি/টিআর

You may also like