জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দী থাকাকালে তিনটি বই লিখেছেন। যদিও বইগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। এরপরে পেরিয়ে গেছে তিন যুগের বেশি সময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ বাসনার অবসান শেষে ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধুর লেখা প্রথম বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হয়। জাতি জানতে পারে বঙ্গবন্ধুর লেখনী ক্ষমতা সম্মন্ধে। বঙ্গবন্ধু শুধু সফল রাষ্ট্রনায়কই ছিলেন না তিনি ছিলেন সুলেখকও।
তিনটি বই-ই সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ। সময়কে খুঁজে পাওয়া যায় বই তিনটিতে। এখানে একদিকে শেখ মুজিবের চিন্তার মগ্নতা গভীরভাবে রূপায়িত হয়েছে, অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক জীবন তখনকার সময়ের পটভূমিতে চমৎকারভাবে তিনি উঠিয়ে এনেছেন। পাশাপাশি চোখ রেখেছেন জগতের নানা দিকে। খুঁটিনাটি নানা বৃত্তান্ত এবং নিজের অনুভবের সারাৎসারে তাঁর প্রতিটি বই হয়ে উঠেছে অনন্য।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী
বঙ্গবন্ধুর প্রথম বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এটি লেখা হয়েছে ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি কারারুদ্ধ। আত্মজীবনীর শুরু হয়েছে তাঁর জন্মের সময় থেকে; পাশাপাশি এসেছে পিতৃপুরুষের কথাও। আর বইটি শেষ হয়েছে ১৯৫৪ সালের ঘটনাবলি দিয়ে। আত্মজীবনীটি বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি। কিন্তু সরল আর প্রাঞ্জল ভাষায় নির্মোহভাবে ঘটনাবলির বর্ণনা এবং সময়ের ঐতিহাসিক বিবরণ থাকার কারণে পাঠক তরতর করে এগিয়ে যেতে পারেন।
এ বইয়ে নিজের জীবনদর্শনের এমন অনেক প্রসঙ্গ আছে, যা একজন ব্যক্তিকে বোঝা সহজ করে দেয়। এভাবে বাঙালির মানসচেতনায় সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে এই বইটি।
কারাগারের রোজনামচা
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বই কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)। এই গ্রন্থের নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা। এই বইও বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে রচনা করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতো এটিও নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রকাশিত হয়।
এই বইও বঙ্গবন্ধু লিখেছেন স্বচ্ছ–স্বাচ্ছন্দ্য ভাষায়। এখানেও চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে প্রকৃতির অনুষঙ্গ, ‘আমার ঘরের কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা–১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।’
বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের জীবনও উপলব্ধি করেছেন জেলখানায় বসে। তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি, ‘কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দীদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা খাওয়ার চিন্তা করতে হবে। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দীর স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।’ পুরো বইয়ের অনেক জায়গায় এমন অনেক মন্তব্য আছে, যেটা পড়লে রাজনীতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে দার্শনিক যোগ, সেগুলো বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পায়।
আমার দেখা নয়াচীন
তাঁর তৃতীয় বই আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। এটিও কারাগারে রাজবন্দী থাকার সময়ে রচিত। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সে সময় নয়াচীন দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে বইটি রচিত। তবে এখানে তিনি শুধু ভ্রমণবৃত্তান্তই তুলে ধরেননি, নয়া চীনের সমাজ-দর্শনও এসেছে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকদর্শন ও মূল্যায়নমূলক পর্যালোচনাও সমৃদ্ধ করেছে বইটিকে।
এ তিন বইয়ে যে সহজ ভাষাভঙ্গি, বিভিন্ন ঘটনাকে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা, মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ ও লেখার মধ্যে সরস প্রবাহ- এই সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য রচনাশৈলীর প্রতীক, যা লেখক হিসেবে তাঁর সার্থকতাকেই প্রকাশ করে।
ভয়েস টিভি/নিজস্ব প্রতিবেদক/এসএফ