Home মুক্তমত বাদ্যচুম্বিত মানুষ সত্যনারায়ন

বাদ্যচুম্বিত মানুষ সত্যনারায়ন

by Amir Shohel

যাকে নিয়ে আমার এ লেখা, কখনই তার সঙ্গে কথা হয়নি। তবে তাকে দেখেছি। যে ক’বার দেখার সুযোগ হয়েছে, তার বাড়ির সামনে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা এবং বর্ডার দেয়া সাদা শর্ট পাঞ্জাবী এবং সাদা ধুতি পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। তখনও জানা হয়নি তার পরিচয়। অনেক পরে জেনেছি তিনি খ্যাতিমান বাদ্যশিল্পী সত্যনারায়ন রায়।

আমি ১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়ার স্থানীয় দৈনিক আজকের আলো পত্রিকার ডেক্সে সাংবাদিকতা শুরু করি। তখন পত্রিকার অফিস ছিল হাজী মার্কেটে। এনএস রোডের সঙ্গে নামকরা এই মার্কেট এবং সেখানকার রহমান ফার্মেসীর কথা সবার জানা। এখন সেই মার্কেটের চিহ্নটি পর্যন্ত নেই। বর্তমানে লাভলী টাওয়ারের ঠিক পূর্ব পার্শ্বে একটি বাড়ি সংলগ্ন চারকোণা সরু আয়তনের ছিল মার্কেটটি। সেখানে রশনী ইলেক্ট্রনিক্স, পল্টুর ইলেক্ট্রনিক্স, আজাদের টেলিভিশন মেরামতের দোকান, ফটো স্টুডিও, আকুর পান-বিড়ির দোকানসহ বেশ কিছু দোকান এবং আলো কম্পিউটারস ছিল। পরে সেটিই রূপ নেয় দৈনিক আজকের আলো পত্রিকায়। এই পত্রিকা অফিসের খুব সন্নিকটে সত্যনারায়ন বাবুর বাড়ি। তার বাড়ির সামনে এখনও বেশ কয়েকটি চটপটির দোকান বসে। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম। তখন এক বয়োজ্যেষ্ঠকে দেখেছি কালো মোটা ফ্রেমের চশমা এবং বর্ডার দেয়া সাদা শর্ট পাঞ্জাবী এবং সাদা ধুতি পরে অবাক দৃষ্টিতে এনএস রোডের দিকে চেয়ে থাকতেন। কী ভাবনা ছিল তার, কখনও জানা হয়নি। তবে তিনি হয়তো ভাবতেন, একদিন এই শহর অচেনা হবে। তিনি থাকেন না, থাকবে না তার শিল্পিত তালের ধ্বনী। তার বাদ্যের তালে আর কেউ গান করবে না। বিদায় বেলার বিকেল এবং সন্ধ্যা তিনি উপভোগ করতেন নিঃসঙ্গ নির্বাক দৃষ্টিতে। তার এই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা দেখে মাঝে-মাঝেই আমাদের নজর আটকে যেতো। বলাবলি করতাম তিনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন? একেক জনের একেক কথা বিশ্বাস হতো না। এরই মাঝে চটপটি খাওয়া শেষ হলে আবার এসে অফিসে ঢুকতাম। এভাবে ওই বয়োজ্যেষ্ঠকে নিয়ে আমার ভাবনাও হারিয়ে যেতো।

কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে আমি যখন অনার্সে পড়ি। তখন হঠাৎ করেই কুষ্টিয়ায় থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। কলেজ থিয়েটার এবং বোধন থিয়েটার নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটতো। তখন আমার কাজ ছিল তিনটি- লেখাপড়া, সাংবাদিকতা এবং থিয়েটার চর্চা। এই থিয়েটার চর্চা করতে এসে ২০০০ সালের দিকে জানতে পেলাম এনএস রোডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি প্রখ্যাত দিলরুবা বাদক সত্যনারায়ন রায়। কুষ্টিয়ায় তার মতো বাদক আর দ্বিতীয়টি ছিল না। তার সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধাভাজন মহাত্মা লালিম হক, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম এবং নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী আফরোজ পিনুর কাছে খুব বেশি জেনেছি। পরে যখন দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন তার সম্পর্কে আরো বিস্তর জেনেছি। তিনি তৎকালে একজন দাপুটে তাল বাদক ছিলেন। প্রতিটি সঙ্গীতের আসরেই তাকে দেখা যেতো। সদালাপী, মিষ্টভাষী এবং নিরব শ্রোতা হিসেবেও তার সু-খ্যাতি ছিল। তিনি বাদ্য-বাজনার পাশাপাশি স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ব্যবসায় কখনই খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না। তার দাদা নিমাই রায় অঙ্কন শিল্পী এবং সুবল চন্দ্র রায় ছিলেন তবলা বাদক। তার বেড়ে ওঠাও ছিল শিল্পী পরিবারে। একারণে জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে তিনি শিল্পী সত্ত্বা নিয়েই বেঁচে থেকেছেন।

সত্যনারায়ন সম্পর্কে আরো জানার সুযোগ হয়েছে তার ছেলে সাধনের মাধ্যমে। বয়সে সে আমার অনেক বড়। তবু তার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সাধন দা কিছুটা উদাস মনের মানুষ। তবে তার যখন যে দিকে খেয়াল, সেদিকে জোঁকের মতো লেগে থাকতো। কোনো আলসি আবোদ বা উগ্রতা নেই, আদায় করতেই হবে যেকোনো উপায়ে; এটা তার অত্যন্ত ভাল একটা স্বভাব। এটা উপলব্ধি করলাম তার বাবাকে নিয়ে আমার এই লেখা আদায় করার ধৈর্য্য দেখে। আমি যে খুব উচুমানের লেখিয়ে তা নয়, এরপরও তার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বোধোদয়ে এক আড্ডায় সাধন দা বলে বসলেন, তার বাবাকে নিয়ে একটা লেখা দিতে হবে। আমি অকপটে স্বীকারও করলাম। এটা যে আমার জন্য কাল হবে জানতাম না। আর সাধন দাও এতো নাছোড়বান্দা, কখনও ভাবতে পারিনি। আমি আজ, কাল বলে কয়েক মাস পার করেছি। ভেবেছি সে হয়তো ভুলে গেছে আর লেখার তাগিদ দিতে আসবে না। বারবার প্রতিশ্রুত ভঙ্গ করার পরও সে আমার অফিসে এসে বসে থাকেছে। আন্দোলনের বাজার পত্রিকা অফিসে তার নিয়মিত অপেক্ষা দেখে একসময় বিরক্ত হয়েই লেখায় মনোযোগি হলাম। আসলে আমি ভেবেছিলাম সাধন দা এক সময় আমার ওপর রাগান্বিত হয়ে লেখাটির খবর নিতে আসবে না। বরং সে এতোবার এসেছে এবং মোবাইল করেছে, আমার হিসেব নেই। আমি তার কাছে হেরে গেছি। আর এই হেরে যাওয়াটা একজন গুণী মানুষের নিয়ে লেখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যা আমাকে কৃতজ্ঞতায় বেঁধে ফেলল অনন্তকালের জন্য। আসলে আমি সাধন দা’কে বারবার ঘুরিয়েছি, এর অর্থ লিখতে চাইনি তা নয়; স্থানীয় পত্রিকা আন্দোলনের বাজার এবং জাতীয় পত্রিকা যায়যায়দিনের জন্য সারাদিন কাজ করে লেখার শক্তি হারিয়ে যেতো। পরে লিখবো করে আর হয়ে উঠতো না। একারণে সাধন দা’কে আমার কাছে বারবার ঘুরতে হয়েছে।

সাধন দা তার বাবার খুবই প্রিয় ছিল। অনেক স্মৃতিকথা তার জানা। একদিন কথা বলতেই তার বাবাকে নিয়ে সে বললো- কত লোক আসতো বাবাকে ডাকতে। বাবা না হলে কোনো অনুষ্ঠানই হতো না।

এই দিলরুবা বাদক এখন আর নেই। এক দুপুরে আমার মোবাইলে লালিম হকের নাম ভেসে উঠলো। তিনি খুব আবেগ তাড়িতো হয়ে বললেন, সত্যনারায়ন বাবু আর নেই। তিনি স্বর্গীয় জীবন লাভ করেছেন।

সেদিন ছিল ২০০৫ সালের ৭ নভেম্বর সোমবার ভোর। এই দিনেই তিনি জাগতিক আশ্রম ত্যাগ করেন। এই সংবাদটি আমি ছবিসহ আন্দোলনের বাজার পত্রিকায় ‘কুষ্টিয়ার খ্যাতিমান বাদক সত্যনারায়নের দেহবসান’ শিরোনামে ছেপেছি। সংবাদটি শুধু আমাদের পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল। সেই সংবাদটি ছিল- ‘কুষ্টিয়ার খ্যাতিমান এসরাজ ও দিলরুবা বাদক সত্যনারায়ন রায়ের দেহবসান হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তিনি সোমবার ভোরে কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়ার নিজ বাসভবনে স্বর্গীয় জীবন লাভ করেন। কুমারখালী এলঙ্গীপাড়ার রাধা বিনোত রায় ও কৃষ্ণমতি রায়ের পুত্র সত্যনারায়ন রায় ছোট বেলা থেকেই ছিলেন সাংস্কৃতি অনুরাগী। তৎকালে প্রখ্যাত ওস্তাদ ও ক্লাব থেকে তিনি বাদ্যজ্ঞান লাভ করেন। তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র নামকরা বাদক। তাকে নিয়েই সল্প জনবহুল এই শহরে বসতো গানের আসর। এখন সেই আসরের গায়েনরা না থাকলেও রয়েছে অনেক নবীন শ্রোতা। তাদের মুখেই শোনা এই খ্যাতিমান বাদকের কথা। দেহবসানকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী গীতা রানী রায় ও এক পুত্র সুব্রত রায় সাধন। বাদক সত্য নারায়ন রায় বাংলা ১৩২৫ সালের ২৩ আশ্বিন এবং ইংরেজী ১৯১৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এই গুণী বাদকের মরদেহ সোমবার বিকেল ৩টায় কুষ্টিয়া মহাশ্মশানে দাহ্য করা হয়েছে।’ তার দেহবসানের খবর অনেকের কাছে না পৌঁছালেও তার নিরব শব যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন গুণী সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ। শ্রাদ্ধি অনুষ্ঠানে এক ঝাঁক তার ভক্তদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। একই সঙ্গে অনুমান করতে সক্ষম হয়েছি তাঁর জনপ্রিয়তার গভীরতা নিয়ে। তাঁর মতো মানুষের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এতে আরো অনেক সত্যনারায়ন সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
rizvynca@gmail.com

You may also like