Home জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় গাঁথা ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় গাঁথা ইতিহাস

by Newsroom
বিজয়

বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘকালের স্বাধিকার আন্দোলন ও সংগ্রাম রূপান্তরিত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধের সূচনা, পরিকল্পনা, লড়াই ও বিজয়ের পেছনে রয়েছে নানা ঘটনা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এমন বিজয়ের অনন্য ইতিহাস আর কোনো জাতির নেই।

ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামল। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। এতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের অধিকার পায়। কিন্তু   শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে শুরু হয় নাটকীয়তা।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই নেতা, দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠক করেন। ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকতে থাকেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো।

বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার আহ্বানে সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে যায়। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে আন্দোলন প্রশমিত হয়নি।

১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ! রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে বাঙালির মনে। ঐতিহাসিক ভাষণটি গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে। সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।

১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরের সেই ঘটনা ছিল যুদ্ধ শুরুর আগে সাধারণ মানুষের প্রথম প্রতিরোধ।

১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরি ভিত্তিতে “সরকারি যাত্রী” পরিবহন করতে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে। এই সরকারি যাত্রীদের প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা। এমভি সোয়াত নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙালি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে, যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ। অনেক আশা সত্বেও ২৫শে মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয়নি। পরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনের সবুজ সংকেত দিয়ে গোপনে ইসলামাবাদে ফিরে যান ইয়াহিয়া।

পরিস্থিতি টের পেয়ে ২৫শ মার্চ রাত আনুমানিক ১১ টার দিকে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র লিখেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমে তার যোগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চট্টগ্রামের ই, পি, আর বাহিনীর কাছে পাঠান তিনি। এর পরপরই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাপত্রটি ২৬ তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।

ঘেষণা পত্রে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।

২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যাযজ্ঞ। যা চলে দীর্ঘ নয় মাস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীতে সহায়তা করেছে বাংলাদেশি কিছু ঘাতক দোসর। ফলে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আসে জাতীয় মুক্তি। দর্শক এখন আপনাদের জানাবো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম সময়ের কথা।

অপারেশন সার্চলাইটের বীভৎসতা এতটাই নির্মম যে- হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞের অতীত সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের ভয়ালতম গণহত্যার রাত । ইতিহাসের জঘন্যতম এই গণহত্যার রাতে, নিরস্ত্র বাঙালির রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে, পাকিস্তানি বাহিনী মৃত্যুর মিছিলকে শত থেকে হাজার এবং হাজার থেকে লাখে রূপান্তর করার পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছিল।

হত্যাকাণ্ডের খবর যেন পৃথিবীর অন্যান্য কোন দেশে না-পৌঁছায়, সেই লক্ষ্যে ২৫শে মার্চের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা পরিত্যাগে বাধ্য করা হয়। তারপরও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন।

মার্চের শেষদিক থেকেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশেষভাবে তাদের রোষের শিকার হয়। দলে দলে মানুষ ভারত সীমান্তের দিকে পালাতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শরণার্থীদের এই স্রোত নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এ সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার মুক্তাঞ্চলে সরকারের শপথ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় হওয়া সত্ত্বেও আকাশবাণীসহ আরও দু’একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এ তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। পরিবর্তিতে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। মুজিবনগরের অস্থায়ী সরকারের সদস্য ছিলেন ৬ জন। এদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খন্দকার মোশতাক আহমদকে আইন, সংসদীয় ও পরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী ভারত সরকারের  সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয়।

১৮ এপ্রিল জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু অস্ত্রপ্রাপ্তি ও প্রশিক্ষণ – এই দুইয়ের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে পেতে জুন মাস পার হয়ে যায়। ১১ জুলাই তৈরি করা হয় বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড।

অবশেষে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পরিকল্পিত রূপ দিতে বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করেন।

চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ১নং সেক্টর। ২নং সেক্টরের আওতায় ছিলো ঢাকা, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও কুমিল্লার অংশবিশেষ। সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় ৩নং সেক্টর। ৪নং সেক্টরের আওতায় ছিলো সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি সড়ক পর্যন্ত। সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সিলেট জেলার সমগ্র উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠন করেছিলো ৫নং সেক্টর। সমগ্র রংপুর জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা নিয়ে হয় ৬নং সেক্টর। দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা জেলা নিয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়। সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত হয় ৮নং সেক্টর। ৯নং সেক্টর গঠিত হয় দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনার দক্ষিণাঞ্চল এবং সমগ্র বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে। ১০নং সেক্টরের আওতায় কোনো আঞ্চলিক সীমানা নেই। এ সেক্টর নৌবাহিনীর কমান্ডো দ্বারা গঠিত ছিলো। শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হত তাদের। আর ১১নং সেক্টর গঠিত হয় কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল নিয়ে।

আরও পড়ুন- পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে বিএনপির দহরম-মহরম বহু পুরোনো

আগস্টের পরপরই বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারীদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে সামরিক স্থাপনা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

গেরিলা হামলায় স্বল্পপ্রশিক্ষিত গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। রাজধানী ঢাকাতেও ক্র্যাক প্লাটুন বেশ কয়েকটি দুঃসাহসী অভিযান চালায়। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে, চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলো মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে।

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর নিয়মিত কাজ ছিল সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করা এবং বাঙালিদের ওপর নির্যাতন করা। সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের জবাবে তারা এ অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে, তারা দিনের বেলাতেও নিজেদের সামরিক ঘাঁটি থেকে বের হতে ভয় পেত।

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হতে থাকে। তখন উপায়ান্তর না-দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতে বিমান হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার চেষ্টা চালায়। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে।

৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ঠিক ওই সময় ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর মধ্যরাতের কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভুটান ও ভারত পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের কিছুই করার নেই বলে অভিমত প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানের পুরোনো বন্ধু চীন, কৌশলগত কারণে যুদ্ধবিরতির জন্যে চাপ প্রয়োগ করেছিল। অন্যদিকে দীর্ঘ আলোচনার পর ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। এছাড়া সেসময় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা পরস্পর মিত্র হওয়ার কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল।

ভারত-বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানিরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল। যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে। কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলেনি।

ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে আহবান জানায়। ঠিক তখন স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী।

পাকিস্তানপন্থী বাঙালি বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের দল ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।

১৪ ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়। যার মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি অন্যতম। বর্তমানে এ বধ্যভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বহুসংখ্যক বাঙালি নারী সম্ভ্রম হারায়; যার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ধারণা করা হয় প্রায় ২,০০,০০০ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয়। ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে পাকিস্তানি সৈন্যরা বহুসংখ্যক মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে।

মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানীদের ঘিরে ফেলে। সেই সঙ্গে সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হয়। অবশেষে জেনারেল নিয়াজির অনুরোধে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ন-টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়।

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশে অবস্থান করা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

ন,মাসে যত রক্ত প্রবাহিত হলো বাংলার সবুজে সবুজে, যেন অত জল গড়ায়নি গঙ্গা-যমুনায়! রক্তে রক্তে এখানকার সবুজেরা রক্তিম সূর্যকেও হার মানিয়েছিল সে বেলায়। রক্ত দিয়েই সীমানা গড়েছিলেন বীর বাঙালি। তাই তো লাল-সবুজের পতাকা ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশের-এর প্রতিচ্ছবি।

পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের প্রাচীর ভেঙে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে বিজয়ের সূর্য উদয় হয় আরো রক্তিম হয়ে। অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়ের।

পৃথিবীতে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর এই বিজয়ের মহানায়ক, ইতিহাসের চির অম্লান ও ভাস্বর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এরপর স্বাধীন দেশে ফিরে আসে ভারতে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করা প্রায় কোটি মানুষ। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার দেশে ফিরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। হাজার বছরের শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাগ্রত বাঙালি বাংলাদেশকে জাগিয়ে তোলে। দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে।

ভয়েস টিভি/তৌহিদ

You may also like