চীনের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া ছোট একটি দেশের নাম হংকং। আকারে ছোট হলেও বিশ্বের অর্থনীতির বাজারে সবচেয়ে সচল চক্রনাভি আর বিলাসবহুল কেনাকাটার জায়গা বলা হয় এই দেশটিকে। তবে আধুনিকতাকে ছাপিয়ে এখানকার সবচেয়ে সূক্ষ্ম যে বিষয়টি আপনার নজর কাড়বে তা হলো এর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চর্চা।
পর্যটকদের জন্য হংকং সাজিয়ে রেখেছে এমন সব জায়গার সমাহার যা এখানে প্রতিবছর ঘুরতে আসা প্রতিটি পর্যটককে মুগ্ধ করে তোলে মূহুর্তে মূহুর্তে। চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক হংকং শীর্ষ সেসব ভ্রমণস্থান যা হংকং ভ্রমণকালে থাকবে আপনার পছন্দের তালিকার একদম শীর্ষে।
এশিয়াকে পৃথিবীর বুকে সুপরিচিত করতে যে কয়টি রাষ্ট্রকে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় হংকং তার মধ্যে অন্যতম। প্রাক্তন এই ব্রিটিশ কলোনি চীনের প্রবেশদ্বার বলা যেতে পারে। তবে সেখানকার মানুষ এবং তাদের সংস্কৃতিতে চীনা প্রভাব থাকলেও তা চাইনিজদের থেকে অনেক আলাদা।
দীর্ঘদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার কারণে তাদের চলাফেরা, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে প্রায় জীবনের সবক্ষেত্রেই পশ্চিমা প্রভাব খেয়াল করা যায়। পুরো হংকং শহর অনেক উন্নত এবং পরিকল্পিত উপায়ে তৈরি করা। ছোট এই এলাকার জনবসতি অনেক বেশি হলেও পর্যাপ্ত পরিকল্পনার কারণে এখানে নেই কোন ট্রাফিক জ্যাম বা অন্য কোন অব্যবস্থাপনা।
নেই দুর্নীতি, নোংরা পরিবেশ অথবা নিরাপত্তাহীনতা। হংকংয়ের আরো প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে চাইলে এর আশেপাশে ছড়ানো দ্বীপগুলো বেড়াতে যেতে হবে। এখানে পাবেন অনেক সুন্দর সব সৈকত এবং সব ধরনের আধুনিক সুযোগ সুবিধা।
হংকংয়ে ভ্রমণকালে পর্যটকরা যে একটি বিশেষ ভ্রমণের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন তার নাম ভিক্টোরিয়া হার্বারের স্টার ফেরী ভ্রমণ। ১৮৮০ সাল থেকে শুরু হওয়া হংকংয়ের এই স্টার ফেরীতে চড়তে খরচ করতে হয় মাত্র কয়েক হংকং ডলার।
প্রায় সব ধরনের আকারের ফেরী বা জাহাজ রয়েছে এখানে। হংকংয়ের শিম শা শুই থেকে সেন্ট্রাল নামক এক জায়গার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন কয়েক মিনিটি পরপর স্টার ফেরী ছেড়ে যায়। যখন হংকংয়ের মতো ছোট আয়তনের দেশের যানজটে ফুসফুস চাইবে একটুখানি প্রাণবন্ত বাতাস টেনে নিতে তখন আপনার দরকার হবে স্টার ফেরীর।
শিম শা শুই থেকে সেন্ট্রাল পর্যন্ত স্টার ফেরীর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এতই ভালো যে ফেরার পথে আপনি আবার সেন্ট্রাল থেকে শিম শা শুই স্টার ফেরীতেই ফিরবেন। এখানকার পানির বাতাসে অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করে। যেহেতু কয়েক মিনিট পর পরই ফেরী ছাড়ে এবং সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ফেরী চলমান থাকে তাই যেকোনো সময়ই পাওয়া যাবে ফেরীর রেলিংয়ের ধারের একটি সিট।
হংকংয়ের সবকিছু পাখির চোখে দেখতে যে জায়গাটায় আপনার অবশ্যই যেতে হবে তার নাম ভিক্টোরিয়া পিক। এখানকার স্কাইলাইন পুরো হংকং বিখ্যাত। ট্রামে করে চলে যাওয়া যায় অত্যন্ত উঁচু এই জায়গায়। ভিক্টোরিয়া পিকে যাওয়ার ট্রামটি পাওয়া যাবে হিলটন হোটেলের পেছনে অবস্থিত মুররে ভবনের ঠিক সামনে থেকে।
এই ট্রামটি আপনাকে নিয়ে যাবে হংকংয়ের অন্যতম উচ্চতম স্থান ভিক্টোরিয়া পিকে যেখান থেকে চোখের দৃষ্টিতে ধাঁধা লাগাবে পুরো হংকং দ্বীপ, জমকালো শহর আর স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো। এত উঁচুতেও খুব সুন্দর করে সাজানো এক পার্ক বানানো আছে পর্যটকদের জন্য।
পড়ন্ত বিকেলের সময়টাই নাকি ভিক্টোরিয়া পিকে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। সূর্যাস্তের ঠিক আগে আগে গোধূলী বেলায় সেই পার্কে কাটানো এক-দুই ঘণ্টার অভিজ্ঞতার অপার্থিবতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ভিক্টোরিয়া সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্টে ঘুরতে আসলেই আপনি বুঝে যাবেন কেন হংকংকে বিশ্বের সবচেয়ে সচল অর্থনৈতিক চক্রনাভি বলা হয়। যেখানেই তাকাবেন এই নগরীর শুধু স্কাইলাইন উঠে যেতে দেখবেন আপনার পাশ থেকে। এখানকার গগনচুম্বী অট্টালিকায় ঘেরা আর আধুনিকতায় ভরা জাঁকজমক দেখতে প্রচুর পর্যটক ভিড় জমায় এখানে।
সবচেয়ে জনপ্রিয় সুউচ্চ ভবনটির নাম “ব্যাংক অফ চায়না” যা একসময় হংকংয়ের সবচেয়ে উঁচু ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল এবং যা এখনো বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনগুলোর মধ্যে একটি। যদি মানবহাতে তৈরী এই ভবনাদি দেখতে ভালো না লাগে তবে ঘুরতে যেতে পারেন “মান মো টেম্পল”য়ে যা হংকং দ্বীপের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ চাইনিজ মন্দির।
হংকংয়ের সবচেয়ে নতুন নিদর্শনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ওয়ং তাই সিন টেম্পল। এটি ১৯২০ সালের দিকে বানানো একটি ব্যক্তিগত মন্দির বিশেষ ছিল যা ১৯৬৮ সালের দিকে নতুন করে তৈরী করা। ১৯৬৮ সালের বানানো সেই নতুন মন্দিরটিই আজকের ওয়ং তাই সিন টেম্পল যা সকল পর্যটকের জন্য উন্মুক্ত।
মন্দিরটি হংকংয়ের কওলনে অবস্থিত এবং এটি নির্মাণ করা হয়েছিল তাওইস্ত ঈশ্বর “ওয়ং তাই সিন”কে সম্মানপ্রদর্শন করে। ওয়ং তাই সিনকে হংকংয়ে ঘোড়সওয়ারি প্রতিযোগিতার ভাগ্য আর রোগমুক্তকারী ঈশ্বর হিসেবে মানা হয়।
প্রতি বছর বর্ষাকালে এখানে ওয়ং তাই সিনের নামে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন মন্দির ভবনে গড়া এই বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সটির অন্যতম ভবনগুলো হলো “হল অফ থ্রি সেইন্টস”, “গুড উইশ গার্ডেন” ইত্যাদি। মন্দিরের হলরুমে পাওয়া যাবে প্রচুর ভাগ্যপরীক্ষকের দেখা। মন্দির ঘুরতে আসা সকলেরই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে ইচ্ছেমতো অনুদান দিতে হয়।
হংকংয়ের ল্যানটাও দ্বীপের পো লিন মনেস্ট্রিতে রয়েছে হংকংয়ের অন্যতম আকর্ষণ, ৩৪ মিটার মানে ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু বুদ্ধ প্রতিকৃতি। ১৯৯৩ সালে এই প্রতিকৃতি স্থাপনার আগে এই এলাকাটি একদম জনমানবশূন্য ছিল।
এই পবিত্র বুদ্ধ প্রতিকৃতিটিকে মানা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মুক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধ প্রতিকৃতি। যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে যান তাদের জন্য এখানে রয়েছে বিশেষ কিছু। এখানকার ভিক্ষুদের দিকনির্দেশনায় সকাল বেলায় উঠে যাওয়া যায় ল্যানটাও শৃঙ্গে আর উপভোগ করা যায় মনেস্ট্রির গা ঘেঁষে উদীয়মান সকালের সূর্যের রক্তিম আভার অপার্থিবতা।
আশ্রমের ঠিক দক্ষিণ দিকে আছে হংকংয়ের একমাত্র চা বাগান আর ল্যানটাও দ্বীপের অন্যদিকে আছে শেক পিক রিসার্ভইর নামক বিশাল এক পানির ড্যাম।
হংকংয়ে কোথায় থাকবেন?- তা নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভিক্টোরিয়া হারবার দ্বারা সজ্জিত, ফোর মরসুম হংকং শহরের কয়েকটি বুদ্ধিমান কেনাকাটা এবং খাবারের বিকল্পগুলির কাছে রয়েছে অপশনস হোটেলটি। এখানে ৩৪৫ টি কক্ষ এবং ৫৪ টি স্যুট রয়েছে। এবং এর রেস্তোঁরাটি ব্যতিক্রমী ফরাসি এবং চীনা খাবার সরবরাহ করে। লাউঞ্জ হোটেলের কাঁচের প্রাচীরযুক্ত অ্যান্ট্রিয়ামের পাশে বিকেলে চা পরিবেশন করে। বহিরঙ্গন ছাদ পুলটি ভাসমান স্টারশিপ এন্টারপ্রাইজের মতো অনুভব করে।
সিম শ সসুইয়ের একটি প্রচারে, আন্তঃমহাদেশীয় ভূগর্ভস্থ এবং মূললাইন রেল স্টেশনগুলির ঠিক পাশেই অবস্থিত এবং হংকং দ্বীপের মুখোমুখি। দ্বিপাক্ষিক লুই বলেরোস দ্রুতগতিতে পরিচালিত কর্মকর্তা এবং ভ্রমণকারীদের একটি মহাবিশ্বের মিশ্রণ তৈরি করেছেন যারা কেবল সেরাকে গ্রহণ করার এক প্রতিমা তৈরি করে। হংকংয়ের শীর্ষ সামাজিক ক্লাবগুলির একটি হোটেল সদস্য, হোটেল অতিথিদের প্রায় যে কোনও জায়গায় প্রবেশের গ্যারান্টিযুক্ত। 4
হংকংয়ের সবচেয়ে উঁচু হোটেলটি শহরের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলির একটি নিয়ে গর্ব করে। পরিবেশ বান্ধব দ্বীপ শ্যাংগ্রি-লাতে সাজানো ৫২৩ টি কক্ষ, নয়টি রেস্তোঁরা এবং বারগুলোতে বিভিন্ন ধরণের খাবার সরবরাহ করে।
সেন্ট্রাল জেলার প্রাণকেন্দ্রে স্ম্যাক এবং নতুন হার্ভি নিকোলস থেকে ক্রেডিট কার্ড টস, হংকংয়ের সুপার ধনী তাই তায়েস ল্যান্ডমার্কটি তাদের সম্মিলিতভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। পরিবেশটি সমৃদ্ধ, সহানুভূতিশীল এবং বিচক্ষণ এবং দর্শনার্থীরা জায়গাটির গোপনীয়তা অনুভব করে।
ল্যান্টাউ দ্বীপে অবস্থিত, সিলভারমিন বিচ হোটেলটি সেন্ট্রাল থেকে দ্রুত ফেরি এবং পোর্টারিং ট্যাক্সি দিয়ে বিমানবন্দর দ্বারা ৩০ মিনিটের দর্শনীয় রাইড। এর পিছনে পর্বতমালা এবং সামুদ্রিক ভিস্তাসহ, এটি হংকংয়ের মতো মনে হয় না।
ইনডোর টেনিস কোর্ট সহ প্রাচীন টুকরো টুকরো টানা এই চকচকে টাওয়ারটি ব্যবসায়ী ভ্রমণকারীদের কাছে প্রিয়। কজওয়ে বেতে অবস্থিত, হোটেলটি দোকানগুলি এবং রেস্তোঁরাগুলির কাছাকাছি এবং ওয়ানচাইতে রাঞ্চি রাতের জীবন এবং হ্যাপি ভ্যালিতে রেসিংয়ের নিকটে।
হংকংয়ের সেরা বারগুলির মধ্যে রয়েছে একোয়া স্পিরিট, ক্লাব ৬৪, এল ডলস ভিটা, পেটিকোট লেন, দ্য লটারি, ফেলিক্স বার।
হংকংয়ে কেনাকাটা করার বেশ কিছু ভালো শপিংমল রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হার্ভে নিখোলস দ্য ল্যান্ডমার্ক, জয়েস বাউটিউইক ওশেন সেন্টার, প্রাদা ওয়ারহাউস মেরিনা স্কয়ার ইস্ট, ডিকসন ওয়ার্যহাউস বাটিকস নিউ ওয়ার্ল্ড সেন্টার, সাংহাই তাং ম্যানশন ১ ডুডেল স্ট্রিট, ওয়ান চেই ওয়েট মার্কেট, স্ট্যানলি মার্কেট, টেম্পল স্ট্রিট নাইট মার্কেট, বিড়াল স্ট্রিট মার্কেট বা ক্যাট স্ট্রিট।
ব্রিটিশদের প্রাচীন উপনিবেশ হংকং মূলত একটি দ্বীপ নগরী। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির সমন্বয়ে হঠিত হংকং সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত। এটি পৃথিবীর অন্যতম দেশ, যার রাজধানী নেই। এটি পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন দেশ, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ ভ্রমণপিপাসুর আগমন ঘটে।
হংকংয়ের রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়বে বিশাল অট্টালিকা। পুরো দ্বীপটি পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত সবুজের মিলনমেলা। আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি অসংখ্য বিনোদন কেন্দ্র ও পর্যটন স্থান রয়েছে।
ঢাকা থেকে ড্রাগন এয়ার সার্ভিসে করে সরাসরি বিমানে হংকং যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে রাত ১২টায় ছেড়ে ভোর ৪টার মধ্যেই হংকং পৌঁছে যাবেন। হংকং বিমানবন্দরে নেমে সেখানে ক্যাব ছাড়াও বাস বা ট্রেনে করে যেকোনো জায়গায় যেতে পারবেন। ঢাকা থেকে হংকং বিমান ভাড়া জনপ্রতি ২২ হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু।
হংকং পর্যটন দেশ হওয়ায় ভিসা প্রসেসিংয়ে তেমন কোনো জটিলতা নেই। তবে আমাদের দেশে হংকং অ্যাম্বাসি বাংলাদেশ সব ধরনের ভিসা প্রসেসিং করে থাকে। অনলাইনে নিজেই ভিসা ফরম এন্ট্রি করার সুযোগ রয়েছে।
হংকংয়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রয়েছে বাস, ট্রেন, মেট্রো রেল, ট্রাম ও ট্যাক্সি। লাল, নীল ও সবুজ রঙের বাহারি ট্যাক্সি রয়েছে এখানে। লাল ট্যাক্সি সবখানেই যেতে পারে। কিন্তু নীল ট্যাক্সি চলে গ্রামের পথে আর সবুজ ট্যাক্সি শুধু ল্যান্টাও দ্বীপে চলাচল করতে পারে।
রাতের হংকং নিজেকে অপরূপ সাজে তুলে ধরে। আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে আলোকসজ্জার নগরী। পরতে পরতে রং-বেরঙের বাহারি রঙিন আলো হংহংকে নান্দনিক রূপ দেয়। নগরীর ক্লক টাওয়ারটি রাতের হংকংকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
এছাড়া পর্যটকদের আকর্ষণ নোং পিং গন্ডোলা লিফট বা ক্যাবল কার। এই ক্যাবল কারে করে উপর থেকে পুরো হংকং দেখতে পারবেন।