Home বিশ্ব বিশ্ব মোড়লের নতুন দাবিদার চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্ব মোড়লের নতুন দাবিদার চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র

by Amir Shohel

বিশ্ব কি আরেকটি শীতল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এমনই এক প্রশ্নের জবাব খুঁজচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, করোনা মহামারির পর টালমাটাল পরিস্থিতিতে তৈরি হতে পারে নেতৃত্বহীন এক বিশ্ব। আর সেই নতুন বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি হুংকার। এরইমধ্যে তারা করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, দক্ষিণ চীন সাগরের দখলসহ নানা ইস্যুতে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। সবশেষ, দুই দেশই একে অন্যের একটি করে কূটনৈতিক স্থাপনা বন্ধ করে দিয়েছে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র টানাপোড়েন শুরু হয় সেই ১৯৪৯ সালে। যখন মাও সে তুঙ চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সেই থেকে দ্বন্দ্ব চলছে পুঁজিবাদি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। যদিও সময়ের সাথে দূরত্ব কিছুটা কমেছিলো। সেটা ১৯৭১ সালের ঘটনা। যখন চীনের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দল চীন সফরে যায়। একইসঙ্গে খুলে যায় চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের নতুন দ্বার। এই সম্পর্কের নাম দেয়া হয়েছিলো ‘পিং পং কূটনীতি’। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোনোদিনও সুমধুর হয়নি। বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দির শুরুতে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান ভাবিয়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কারণ বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের একক আধিপত্যে পথের কাটা হয়ে ওঠে চীন। তাই চীনকে ঠেকাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র।

যার সবশেষ প্রতিফলন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়া। সেইসাথে তিনি চীনের আরো কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দেন। ওয়াশিংটনের দূতাবাস ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পাঁচটি কনস্যুলেট রয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন কি ঘটনা যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দিলো। মার্কিন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, চীন কূটনৈতিক মিশনগুলো ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরগিরির চেষ্টা চালাচ্ছে। হিউস্টনের কনস্যুলেটও এ কাজে ব্যবহার করেছে বেইজিং। তাই কনস্যুলেটটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের জন্য বেইজিংকে নির্দেশ দেয় ওয়াশিংটন। শুধু তাই নয়, চীনা এজেন্টরা টেক্সাসের মেডিকেল ও অন্য গবেষণা কাজ চুরির চেষ্টা চালিয়েছে বলেও দাবি তাদের।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবিকে বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদ আখ্যা দিয়ে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে চীন। একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরির জন্য ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানায় তারা। এই কনস্যুলেট বন্ধের জবাবে সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংদুর মার্কিন কনস্যুলেটও বন্ধ করে দেয় চীন।

সম্প্রতি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমত, মার্কিন কর্মকর্তারা সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার দায় চাপিয়েছে চীনের ওপর। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও অভিযোগ তুলেছেন, ভাইরাসটি চীনের ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ চীন-যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ থেকে অর্থনৈতিক যুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অন্যায্যভাবে বাণিজ্য পরিচালনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরির অভিযোগ করে আসছেন। তবে বেইজিং বলছে, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

আরেকটি দ্বন্দ্বের কারণ, হংকংয়ে চীনের জারি করা নিরাপত্তা আইন। এই আইন বাস্তবায়ন করায় যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলের বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা বাতিল করে। পাশাপাশি ট্রাম্প এমন একটি আইন প্রয়োগ করেছেন যেটি হংকংয়ে মানবাধিকার ক্ষুন্ন করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপকে ঘরোয়া বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দাবি করে সমুচিত জবাব দেয়ার হুশিয়ারি দেয় চীন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু রাজনীতি বা অথনীতি নয়, প্রযুক্তির দিক দিয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠায় মার্কিন রোষানলে পড়েছে চীন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ফাইভ-জি প্রযুক্তির দৌড়ে হেরে গেছে। নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি ফাইভ জি বিশ্ব বাজার দখল করে নেয়ায় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও টার্গট করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বড় সংঘাত তৈরি হয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের আধিপত্য নিয়ে। কারণ এই সাগরে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। এছাড়া এখানে মজুত রয়েছে প্রচুর খনিজ তেল ও প্রকৃতিক গ্যাস। এই খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস আর বাণিজ্যের জন্যেই দক্ষিণ চীনসাগর বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে বেশ গূরুত্বপূর্ণ।

তবে চীন শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই সংঘাতে জড়িয়েছে তা নয়। ভারত চীন সীমান্তেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারতকে কোণঠাসা করতে চীন ইতোমধ্যে পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও নেপালে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রচুর টাকা ঢালছে। এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোতে চীনের এই উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

করোনা পরবর্তি বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য চীন-যুক্তরাষ্ট্রের লড়াইয়ে কারা জয়ী হবে। তা নির্ভর করছে দুদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার।
লেখক: ফেরদৌস মামুন, সাংবাদিক

You may also like