মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি ভালোবাসা একজন ঈমানদারের ঈমান তথা বিশ্বাস এবং অন্তরের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিমাপক। আমাদের ঈমান শুধু তখনই সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হবে যখন নবীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা এ দুনিয়ার সব কিছু, এমনকি আমাদের নিজ জীবন অপেক্ষা অধিক হবে। (সূরা আহজাব : ৬)।
নবী করিম সা. এক হাদিসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার কাছে আমি নিজ সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, এমনকি সমগ্র মানবজাতি অপেক্ষা প্রিয়তর হবো।’ (বুখারি ও মুসলিম) মুমিনদের মধ্যে সেই সব সাহাবী, বিশেষত যারা ছিলেন শ্রেষ্ঠতমদের অন্তর্ভুক্ত, তারা প্রিয় নবীর প্রতি এ রকমেরই ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। মদিনার জনগণের পক্ষ হতে নবী করিম সা. সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা বলেন- ‘মহানবী সা. আমাদের কাছে আমাদের সহায়-সম্পত্তি, সন্তানাদি, পিতা-মাতা, পূর্বপুরুষ এবং প্রচণ্ড পিপাসার্ত অবস্থায় ঠাণ্ডা পানি অপেক্ষা প্রিয়তর।’’
মুমিনরা প্রিয় নবীকে এভাবেই ভালোবাসবে- কারণ, তিনি তো তাদের শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং নেতা, আর তাঁর পক্ষে শিক্ষা দেয়া, পথপ্রদর্শন করা এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব যদি তারা তাঁকে ভালো না বাসে। তবে ঈমানের জন্য নবীর প্রতি ভালোবাসা অতীব প্রয়োজনীয়- এই নীতির আরো গভীর অর্থ আছে। মহানবীর প্রতি ভালোবাসার অর্থ হলো চরিত্রের সব সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, নম্রতা থাকা, যা মানুষ অর্জন করতে পারে এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে যা নবী করিম সা:-এর ছিল উচ্চতম মাত্রায়। মহানবীর প্রতি ভালোবাসা মানে আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভেতরে যেসব কল্যাণ ও মহত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন সে সবকিছু গ্রহণ এবং লালন করা ও সেগুলোর মহিমা প্রকাশ ও প্রচার করা।
মহানবী সা.-এর প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করা যেতে পারে তাঁকে মহিমান্বিত করা ও তাঁর ওপর দরূদ ও সালামের মাধ্যমে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করো আর তাঁকে যথাযোগ্য সম্মানে সালাম করো।’ (সূরা আহজাব : ৫৬)।
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা কিভাবে নবীর ওপর ভালোবাসা, মহিমা এবং আশীর্বাদ প্রেরণ করেন আর আমরাই বা কিভাবে তা করি? ন্যূনতম যেভাবে আল্লাহ মহানবী সা:কে ভালোবাসেন তা হলো এই যে, যে-ই তাঁকে অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। আল কুরআন বলছে- ‘বলুন (মানবজাতিকে, হে মুহাম্মদ!) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমার অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)। আল্লাহ তায়ালা আর কিভাবে নবী করিমকে ভালোবাসেন তা শুধু তিনিই জানেন। আল্লাহ তায়ালা যেভাবে নবীকে মহিমান্বিত করেন সেগুলো নিন্মরূপ-
১. তিনি তাঁর নাম দিয়েছেন আহমাদ আর মুহাম্মদ যার অর্থ মহিমান্বিত, প্রশংসিত।
২. তিনি অন্যান্য নবীর মাধ্যমে তাঁর আগমনের সুসংবাদ মানবজাতিকে দিয়ে এসেছেন। (সূরা আলে ইমরান : ৮১, সূরা আরাফ : ১৫৭, সূরা আনআম : ৬১)।
৩. তিনি আসমান ও জমিনের বাসিন্দাদের মধ্যে তাঁর নাম ঘোষণা করে থাকেন- ‘আমরা আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি।’(সূরা ইনশিরাহ : ৪)।
আল্লাহ নবী সা:কে আশীর্বাদ করে থাকেন তাঁর মর্যাদা উন্নয়নের মাধ্যমে। মহানবীর প্রতি আল্লাহ তায়ালার ন্যূনতম আশীর্বাদ হলো- তিনি তাঁকে সমগ্র মানবজাতির নেতা ও প্রতিনিধি বানিয়েছেন।
ফেরেশতারা মহানবীকে ঠিক সেভাবেই ভালোবাসেন যেভাবে একজন রাজার পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত চাকর রাজার প্রিয়ভাজনকে ভালোবেসে থাকে। তাঁরা জান্নাতে তাঁর নামের প্রশংসা করার মাধ্যমে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করে থাকেন। যে রকম উত্তমভাবে তাঁকে ভালোবাসা যায় তা হলো- তাঁর নামে নিজের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা। মুমিনগণ যেভাবে নবীজীর মহিমা প্রকাশ করতে পারে তা হলো- কাব্যিক ভাষা ও গদ্যে তাঁর প্রশংসা করা, লেখনী ও কথার মাধ্যমে, রেডিও ও টেলিভিশনে (আজকাল ইন্টারনেটে), মুসলমান ও অমুসলমানদের সমাবেশে ইত্যাদি। মুমিনরা নবীজীকে ভালোবাসতে পারে প্রচলিত যেসব বিভিন্ন রকমের দরূদ আছে সেগুলো পাঠ করে।
লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ