Home ভিডিও সংবাদ রংপুরের ঐতিহ্য সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ

রংপুরের ঐতিহ্য সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ

by Amir Shohel

রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ। উত্তর জনপদের পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে যে ক’টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম রংপুর সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজ। রংপুর মহানগরীর পায়রা চত্বর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পূর্বদিকে শালবন এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত।

সাহিত্য সংস্কৃতির উর্বরভূমি রংপুর। তাই রংপুর অঞ্চলের আপামর জনসাধারণ, বিদ্যানুরাগী, বুদ্ধিজীবীগণ রংপুর নারী শিক্ষা প্রসারে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। রংপুরবাসীর এই ভাবনার সঙ্গে একাত্ততা ঘোষণা করে তৎকালীন রংপুর জেলা প্রশাসক মো. ইয়াকুব আলী। তিনি স্থানীয় কিছু বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এই মহিলা কলেজটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

কিছুদিনের মধ্যে জেলা প্রশাসক মো. ইয়াকুব আলী অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি চালু হওয়ার সময় পিছিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে মো. আমিরুল ইসলাম রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তারই স্থলাভিষিক্ত হয়ে আসেন জনাব আব্দুস সাত্তার।

ইতিহাস বলছে, তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও. এস. করনী’র পৃষ্টপোষকতায় রংপুরে একটি মহিলা কলেজ স্থাপনের কাজ অনেকটাই এগিয়ে যায়। জনাব আব্দুস সাত্তার ও তার স্ত্রী জার্মান বংশোদ্ভুত এলেন. এ. সাত্তারের জোরালো উদ্যোগ ও সহযোগিতায় এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

স্থানীয়দের মতে, কলেজটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও. এস করণী, রংপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মহমিদুর রহমান, প্রাক্তর সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা ফজিলাতুন নেছা বুলু , অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুস সাত্তার, তার স্ত্রী এলেন. এ. সাত্তার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইকরাম। মূলত, তাদের উৎসাহ উদ্যোগেই এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

১৯৬৩ সালের মার্চে রংপুরের শালবন এলাকার মন্থনার জমিদার কন্যা ‘ বরদা সুন্দরী ও সারদা সুন্দরী’ জমিদার বাড়ির ৩ দশমিক ৬৪ একর জমির উপর ‘রংপুর মহিলা কলেজ’ এর অগ্রযাত্রা শুরু হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এলেন এ. সাত্তার। স্বামীর বদলী হয়ে যাওয়ায় তিনি ছয় মাস পরেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যান। তখন থেকে এই অঞ্চলে শিক্ষার আলোর মিছিলে নারীদের অংশগ্রহণ ও নারী জাগরণের অগ্রদুত মহিয়সী বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ সুপ্রসারিত হতে থাকে এই কলেজটির মাধ্যমে।

এক পর্যায়ে ‘রংপুর মহিলা কলেজ’টি মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার নামানুসারে করার দাবি উঠতে থাকে। রংপুরবাসীর জোরদার আন্দোলনের সঙ্গে তৎকালীন নারী কল্যাণ সংস্থা যোগ দেয়। যোগ দেন অনেক জ্ঞানী-গুণি নারী। বাঙ্গালি মুসলিম নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম সুফিয়া কামাল ও আয়েশা জাফরের আবেদনে এবং রংপুরবাসীর জোরালো সমর্থনে ১৯৬৯ সালের ১৯ জুন কলেজ ম্যানেজিং কমিটির এক সভায় কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বেগম রোকেয়া কলেজ’। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির নাম বেগম রোকেয়া কলেজ।

১৯৬৯ সালের ২৫ জুন কলেজটির মূল ভবনের উদ্বোধন করেন তৎকালীর জনশিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা এম ফেরদৌস। ১৯৭৯ সালের ৭ মে কলেজটি সরকারিকরণ হয়।

কলেজ প্রতিষ্ঠার পর অনেক বছর পর নির্মিত হয় নতুন ভবনগুলো। কলেজের মূল ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার কাজী আজাহার আলী সি.এস.পি। ১৯৯৪ সালের ২৩ জুলাই কলেজের বিজ্ঞান ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার এবং সাধারণ কক্ষ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর কলেজটিতে প্রথমে বে-সরকারিভাবে উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক, কিছুদিন পর বিএ, বিএসএস পাস কোর্স এবং ১৯৭৬ সালে খোলা হয় উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান শ্রেণি। ১৯৭৯ সালে কলেজটি সরকারিকরণের পর ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স পাঠদানের অনুমতি দেয়। ১৯৯৫ সালে ওই ক’টি বিষয়ের উপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স শেষ পর্ব কোর্স চালুর অনুমতি দেয়।

একাডেমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রসারে বিশেষ অবদান রয়েছে কলেজটির। ১৯৮৮ এবং ২০০২ সালে রংপুর জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি অর্জন করে। ২০০৮ সালে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে ১৭ জন, দর্শন বিষয়ে ৪ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ১ জন; ২০০৭ সালে ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিষয়ে ৭ জন, ২০০৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ২ জন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়।

কলেজটি মহিলা কলেজ হওয়ায় নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা রয়েছে। চারদিকে উঁচু দেয়াল ছাড়াও মূল ফটকে রয়েছে দুটো গেট। যেখানে সারাক্ষণ নিরাপত্তা কর্মীরা সতর্ক অবস্থায় দায়িত্বপালন করেন।

মূল গেট পার হতেই মাঠে দেখা মিলবে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি। সবুজ শ্যামল এই গাছের ছায়ায় সুনিবিড় হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসে গেলে, চোখ জুড়িয়ে যাবে যে কোন দর্শনার্থীর।

প্রতিষ্ঠানের জমিদাতা মন্থনা জমিদারের দু’কন্যা জমিদার বরদা সুন্দরী ও সারদা সুন্দরীর স্মৃতি ধরে রাখতে ক্যাম্পাসে বিজ্ঞান ভবনের পাশে ‘বরদা সুন্দরী ও সারদা সুন্দরী’ খোলা মঞ্চ করা হয়েছে। যেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন থাকেন।

মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রয়েছে বিশাল আকারের শহীদ মিনার।

কলেজটিতে পাঁচটি একাডেমিক ভবন ছাড়াও বীর প্রতীক তারামন বিবি ও বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজিলাতুন্নেছা বুলু আপার নামে ৪০০ আসন বিশিষ্ট সুসজ্জিত দুটি ছাত্রী নিবাস রয়েছে। আছে শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রী বিশ্রামাগার। যেখানে ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা সহশিক্ষা হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পারে।

এছাড়াও কলেজ ক্যাম্পাসের ঠিক পশ্চিম পাশে সাংস্কৃতিক চর্চার এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে সুবিশাল অডিটোরিয়াম। আছে বিশাল গ্রন্থাগার ও কম্পিউটার ল্যাব।

ক্যাম্পাসের ঠিক পূর্ব পাশে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যান রয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণ উদ্যান। সেখানে হস্তি পলাশ, বয়রা, পাথর কুচি, হরতকি, গায়নুরা, মহুয়া, বিলাতী গাব, বন আদা, কাজু বাদাম, গোলাপ জম, শতমূল, ঘৃতকুমারী, ডেউয়াসহ শত শত বনজ, ভেষজ ও ওষধি গাছ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই উদ্যান দেখতে আসেন অনেকে।

সাহিত্য এবং সংস্কৃতি পর্যায়ে জাতীয় প্রতিযোগিতা ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯ এ দেশাত্মবোধক, নজরুল গীতিতে অঞ্চল পর্যায় প্রথম, বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম স্থান অর্জন করে। ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন বাংলাদেশ আয়োজিত ৫ম বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ২০১১ এ বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এ কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়।

জাতিসংঘ নারী বিষয়ক সংস্থা এবং বিডিএফ আয়োজিত নারীর প্রতি সহিংসতা আর নয় শীর্ষক সংসদয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০১১ -এ এই কলেজ রংপুর বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়।

বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০০৯, ২০১০ এ জেলা পর্যায়ে ১ম, ২য় এবং বিভাগীয় পর্যায়ে ২য় স্থান অর্জন করে। রোকেয়া দিবস ২০১১ রোকেয়া ফোরাম, রংপুর আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এ কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত ২০১১ নজরুল গীতি প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায় এ কলেজ ১ম, বিভাগীয় পর্যায় ১ম এবং জাতীয় পর্যায়ে ২য় স্থান অর্জন করে।

১৯৯৫ সালে কমনোয়েলথ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবল টীমে এ কলেজের ৩ জন কৃতি ছাত্রী অংশগ্রহণ করেছিল।

বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া এ প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক সংখ্যা রয়েছে অর্ধশত। আর প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারনায় মুখর থাকে তাদের প্রিয় এই ক্যাম্পাস।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like