Home বিশ্ব ভারতের মিত্র থেকে কেন শত্রু হলো নেপাল

ভারতের মিত্র থেকে কেন শত্রু হলো নেপাল

by Newsroom

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অন্যতম বন্ধু দেশ নেপাল। দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক থাকলেও নেপালের অভিযোগ, ভারত সবসময়ই তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। এতে ক্ষুব্ধ নেপালিরা। সবশেষ উত্তরাখণ্ডের পিথাউরাগড়-লিপুলেখের মধ্যে ভারতের লিংক রোড তৈরি নিয়ে দুদেশের দ্বন্দ তীব্র হয়েছে। নেপালের দাবি, এই ভুখণ্ডটি তাদের। এরপর উত্তেজনা তৈরি হয় বিহারেও। সেখানে গণ্ডক বাঁধ সংস্কার কাজে নেপাল বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে ভারত। কিন্তু কেন এই দুই বন্ধু দেশের মধ্যে তীব্র বিবাদ শুরু হলো।

ভারতের উত্তরাখন্ড, চীনের তিব্বত আর নেপালের সীমানা মিশেছে হিমালয়ের একটি গিরিপথে। যার নাম লিপুলেখ। ওই গিরিপথের দক্ষিণের ভূখন্ডটি ‘কালাপানি’ নামেও পরিচিত। এলাকাটি ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এটি নিজ অংশ বলে দাবি করে আসছে নেপাল। সমপ্রতি এই সীমান্তে ৮০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে ভারত।

গেল ৮ মার্চ এই পার্বত্য রাস্তার উদ্বোধন করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এরপরই জ্বলে ওঠে নেপাল। এ ঘটনায় তীব্র ঝড় তোলেন নেপালের রাজনীতিবিদরা। নেপাল সরকারের দাবি, রাস্তাটি উদ্বোধনের সময় কাঠমান্ডুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ওই ভূখণ্ড কোনদিনই নেপালের ছিল না।

নেপাল-ভারতের মধ্যে ১৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গার দখল নিয়ে দুই দেশের বিরোধ চলছে। এরমধ্যে অন্যতম কালাপানি, লিপুলেখ ও সুস্তা সীমান্ত। এরইমধ্যে এই তিন স্থানকে নিজেদের দাবি করে নতুন মানচিত্রও প্রকাশ করেছে নেপাল সরকার। নেপালের এসব কাজে বিব্রত ভারত সরকার। তারা মনে করছে, নেপালকে উসকে দিচ্ছে তৃতীয়পক্ষ।

কিন্তু কেন এই দ্বন্দ। কারণ, লিপুলেখ নেপালের সঙ্গে ভারত-চীন সীমান্তের একটি কৌশলগত ভূখণ্ড। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্যও একটি সুপ্রাচীন পথ। এছাড়া ভারত, নেপাল ও তিব্বতের তীর্থযাত্রীদের যাওয়া আসার সবচেয়ে সহজ রাস্তা। তাই ভারত সরকার লিপুলেখ দিয়ে কৈলাস-মানস সরোবর পর্যন্ত সড়ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এটা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র ভূমি।

নেপালের দাবি, ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এক চুক্তি অনুযায়ী কালি নদীর পূর্বাঞ্চল তাদের। কিন্তু ভারত সবসময় কালি নদীর উৎস ও প্রবাহ বদলে যাওয়াসহ এই অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন প্রমাণ হাজিরের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, ভারত ৬০ বছর ধরেই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে তাদের সেনা মোতায়েনসহ বহু অবকাঠামোও রয়েছে। এসব বিষয়ে নেপাল বারবার কথাবলার চেষ্টা করলেও তাতে কান দেয়নি ভারত।

এদিকে চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতে বিহারসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বন্য দেখা দেয়া। এ বন্যা ঠেকাতে পূর্ব চম্পারণ জেলায় গণ্ডক বাঁধ সংস্কার করতে গেলেও বাধা দেয় নেপাল। কারণ গণ্ডক বাধের ৩৬টি গেটের মথ্যে ১৮টি নেপালের। অনুগত ক্ষুদ্র এই প্রতিবেশীর এই আচরণে বিস্ময় ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ভারতের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-নেপাল সীমান্ত দ্বন্দ্বে তিনটি কারণ- ক্ষমতা, রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা ও সার্বভৌম সীমান্ত। তাই নেপালের বারবার উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পেছনে চীনের মদদকেই দায়ী করেছেন তারা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৫ সালে নেপাল ভয়াবহ ভূমিকম্প। ওই ভুমিকম্পে গোটা নেপাল বিপর্যস্ত হলেও ভারত সরকার নেপালের ওপর পাঁচ মাসের অবরোধ আরোপ করেছিল।

এমন ঘটনা নেপালের সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে জোট বাঁধতে উৎসাহ জোগায়। এই সুযোগে নেপালের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় চীন। তারা পরিবহন, যোগাযোগসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি করে কাছে টেনে নেয় দেশটিকে।

কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নেপালকে উস্কে দেয়ার মতো ক্ষমতা চীনের কতোখানি রয়েছে তা একটি বড় প্রশ্ন। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে নেপালকে শায়েস্তা করতে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ওপর সীমান্তে বাধা দেয় ভারত। এ কারণে নেপালিদের মধ্যেও ভারত বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে। তারপরও ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে নেপালের মানচিত্র বদল, অনেকটা স্বাধীনতার ঘোষণার মতোই।

এতো উত্তেজনার পরও ভারত এসব ঘটনাকে না দেখার কৌশল নিয়েছে। তারা এ নিয়ে নেপালের সাথে কথা বলতেই রাজি নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের সাথে সীমান্তে সামরিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় দিকের গুরুত্ব বিবেচনায়, ভারত হয়তো কখনোই ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে না। তারপরও ভারতকে সমস্যাটির সমাধান করতে হবে, তানা হলে চীন একসময় নাক গলাতে পারে। তাই চীন এখনো চুপ থাকলেও, ভবিষ্যতে পাল্টে যেতে পারে সব হিসেব নিকেশ।


লেখক : ফেরদৌস মামুন, সাংবাদিক

You may also like