Home সারাদেশ পদ্মা সেতু: পিছিয়ে পড়া নড়াইলেও গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা

পদ্মা সেতু: পিছিয়ে পড়া নড়াইলেও গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা

by Shohag Ferdaus
নড়াইল

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে পুরো সেতু। আর সেতুর প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সব কিছু ঠিক থাকলে দ্রুতই এই সেতুর সুফল পাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দূরত্ব কমবে ১২০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার। স্থাপিত হবে বেনাপোল-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল ‘আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ’ ব্যবস্থা। সেতুটি চালু হলে ভৌগোলিকভাবে নড়াইল জেলার গুরুত্ব বাড়বে অনেক। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলে শিল্পায়নের ছোঁয়া লেগেছে।

বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ঢাকা সড়কের হাইওয়ের দুপাশে নড়াইল অংশে জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। ইতোমধ্যে নড়াইল অংশে গড়ে উঠেছে কয়েকটি কলকারখানা। সেখানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে স্থানীয়রা। নড়াইল অংশের রাস্তার দুই পাশে জমি কেনার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানিসহ ছোট ব্যবসায়ীরাও। ইতোমধ্যে বেঙ্গল গ্রুপ, কিষাণ গ্রুপসহ কয়েকটি কোম্পানি জমি কিনেছে। অনেক কোম্পানি জমি কেনার জন্য স্থানীয় লোক নিয়োগ দিয়েছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্প শেষ হলে নড়াইলে ৩১ কিলোমিটার ইকোনোমিকাল জোন হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

গুরুত্ব বুঝে এই হাইওয়ের পাশে নড়াইল জেলার লোহাগড়া কালনা এলাকায় একটি ইকোনোমিকাল জোন করার জন্য ৩ শ একর জমি অধিগ্রহণের একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে প্রাধানমন্ত্রী ইকোনোমিকাল জোনের অনুমোদন দিয়েছেন। এদিকে সদরের ধোপাখোলা এলাকায় এই হাইওয়ের পাশে আরও ৩ শ একর জমিতে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা প্রশাসন।

নড়াইল

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নড়াইল-যশোর সড়কের নড়াইল সদরের দূর্বাজুড়ি এলাকায় হাইওয়ের পাশে কিষান ফিসফিল্ড নামে একটি বড় কারখানা চালু হয়েছে। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে স্থানীয় শতাধিক মানুষের। নড়াইল-লোহাগড়া সড়কের বসুপটি এলাকায় চিত্রা ব্রয়লার ফিড নামে আরেকটি কারখানা চালু হয়েছে কয়েক মাস আগে। এই কারখানাটিতে প্রতিদিন উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ১ শ মেট্রিক টন। এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছে স্থানীয় অর্ধশতাধিক মানুষ। এদিকে নড়াইলের সিতারামপুর এলাকায় রাস্তার পাশে বেঙ্গল গ্রুপ প্রায় ২০ একর জমি কিনে রেখেছে। এছাড়া কয়েকটি স্থানে জমি কিনে বালি ভরাট করছে বেশ কয়েকটি কোম্পানি।

সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর পাশাপাশি নড়াইলে ৬ লেন বিশিষ্ট কালনা সেতুর কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত হাইওয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই ভাটিয়াপাড়া থেকে কালনা-নড়াইল-যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত ৬ লেনের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে নড়াইলের অংশে বাইপাসসহ তিনটি ৬ লেন সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোরও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। একই সঙ্গে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানও পরিবর্তন হবে।

স্থানীয়রা জানান, হাইওয়ের পাশে বিভিন্ন কোম্পানি জমি কেনার জন্য প্রতিনিয়তই ঘোরাফেরা করছে। গত ৩ বছরে এই হাইওয়ের পাশের জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।

ডৌওয়াতলা গ্রামের মশিয়ার জানান, এই রাস্তার পাশে তার নিজের জমি রয়েছে। প্রায়ই তার কাছে জমি কেনার জন্য মানুষ আসে। একই এলাকার আরেক বাসিন্দা তিলক মিয়া জানান, তিন বছর আগে এই রাস্তার পাশে এক শতক জমির দাম ছিল ২৫-৩০ হাজার টাকা, বর্তমানে সেই জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি।

নাকশী এলাকার মুরাদ জানান, কয়েক বছর আগে এখানে জমি বিক্রির জন্য ক্রেতা পাওয়া যেত না। আর এখন ক্রেতারা কয়েকগুণ দাম বেশি দিয়েও জমি কিনতে পারছে না। স্থানীয়দের ধারণা পদ্মা সেতুর পাশাপাশি হাইওয়ে সড়ক চালু হলে নড়াইলে জমির দাম আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।

লোহাগড়া বাজারের ব্যবসায়ী আলীম জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্প আমাদের অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ। বর্তমানে নড়াইল থেকে ঢাকা যেতে ৮-৯ ঘণ্টা সময় লাগে, প্রকল্পটি চালু হলে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানো যাবে। তখন ঢাকার অনেক শিল্পপতিই এসব এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। ইতোমধ্যে অনেকেই হাইওয়ের পাশে জমি কিনছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার জন্য।

নড়াইল দলিল লেখক সমিতির নেতা ইলিয়াস আলী খাঁন বলেন, বছর দু’য়েক হলো এই হাইওয়ের দুপাশের জমি আগের তুলনায় বেশি কেনা বেচা হচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর এই এলাকার জমির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দু’বছর আগের থেকে বর্তমানে জমির দাম ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে । ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরাই এই হাইওয়ের পাশে বেশি জমি কিনছে।

নড়াইল

কিষাণ অ্যাকুমুলেটরস্ লিমিটেড এর কর্মকর্তা আবিদুর রহমান (লিকু) জানান, এই সেতুর মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দর-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক যোগাযোগ’ স্থাপিত হবে। তখন ভৌগোলিকভাবে নড়াইলের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সে জন্য নড়াইলে কয়েকটি শিল্পকলকারখানা স্থাপন করার সিন্ধান্ত নিয়েছে তারা। ইতোমধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি রিসাইকেল প্লান্ট ‘কিষাণ অ্যাকুমুলেটরস্ লিমিটেড’ ও ‘কিষাণ ফিস ফিল্ড’ নামে দুটি কারখানা চালু করেছে। এই কারখানা দুটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে স্থানীয় প্রায় ৪ শতাধিক মানুষের। এছাড়াও আরও কয়েকটি কারখানা নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

নড়াইলে সমাজ কর্মী কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প চালু হলে ঢাকার সঙ্গে বেনাপোলের দূরত্ব কমবে ১৬০ কিলোমিটার। খুলনা বিভাগের সঙ্গে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জ্বালানি খরচ কম ও যাতায়াত সহজ হবে। কৃষি পরিবহন ও বিপনণ সহজ হবে। চাঙ্গা হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর সুফল পাবে খুলনা বিভাগ ও আশপাশের অন্তত ২০টি জেলার কৃষক, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ। বদলে যাবে নড়াইলসহ খুলনা বিভাগের কৃষি, অর্থনিতি ও শিল্পায়ন।

নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি সরদার আলমগীর হোসেন বলেন, সেতু হলে ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দর, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। এতে সময় ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে।

তিনি জানান, কালনাঘাট দিয়ে বেনাপোল-ঢাকা সড়কের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার, যশোর-ঢাকা ১৬০ কিলোমিটার, নড়াইল-ঢাকা ১২৬ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকা ১৯৫ কিলোমিটার। অথচ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা যেতে এসব সড়কে ৩০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সেতুটি চালু হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার দূরত্ব কমবে ১৬০-২০০ কিলোমিটার।

অ্যাডভোকেট তারিকুজ্জামান লিটু বলেন, সারাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে দৃশ্যমান উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট জেলা নড়াইলে এখনও তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। এখানে নেই তেমন কোন শিল্প-কলকারখানা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও নড়াইলে তেমন কোন শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। তবে পদ্মা সেতু, কালনা সেতু, ঢাকা-নড়াইল-বেনাপোল-কোলকাতা হাইওয়ে এবং রেল লাইনের কাজ শুরু হওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তাদের কাছে ভৌগোলিকভাবে নড়াইলের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে।

নড়াইল প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এনামুল কবীর টুকু বলেন, নড়াইলবাসী এতদিন উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল। পদ্মা সেতু, কালনা সেতু, খুলনা-নড়াইল হাইওয়ে ও নড়াইল অংশে রেল লাইনের কাজ শুরু করায় বড় বড় ব্যাবসায়ীদের নজর এখন নড়াইলের দিকে। সেজন্য ২-৩ বছর আগেই নড়াইলে সড়কের পাশে জমি কেনা শুরু করেছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইলে অংশ (৩১ কিলোমিটার) ইকোনোমিকাল জোন হিসেবে পরিণত হবে বলে মনে করনে তিনি।

নড়াইল উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক সাবেক এমপি সাঈফ হাফিজুর রহমান খোকন বলেন, পদ্মা সেতু নড়াইল তথা দক্ষিণ অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ। প্রকল্পটির ফলে নড়াইলে সড়কের দুপাশে বিভিন্ন কোম্পানি শিল্প ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার জন্য ইতোমধ্যে জমি কেনা শুরু করেছে। প্রকল্পটি সম্পূর্ণভাবে চালু হলে নড়াইলে ৩১ কিলোমিটার ইকোনোমিকাল জোন হিসাবে পরিণত হবে বলে মনে করেন সাবেক এই সংসদ সদস্য।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. ফকরুল হাসান বলেন, নড়াইল একটি সম্ভাবনাময় জেলা। পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইল থেকে ঢাকা এবং বেনাপোল স্থল বন্দরের যোগাযোগ অনেক সহজ হবে। ফলে ভৌগলিকভাবে এ জেলার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। তখন বড় বড় ব্যাবসায়ীরা এখানে শিল্প কলকারখানা গড়ে তুলবেন। বিষয়টি অনুধাবন করে সরকার নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় ৩ শ একর জমি নিয়ে একটি ইকোনোমিকাল জোন করার পরিকল্পনা করছে, ইতোমধ্যে প্রাধানমন্ত্রী ইকোনোমিকাল জোনের অনুমোদন দিয়েছেন। এদিকে হাইওয়ের পাশে ধোপাখোলা এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী করার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like