মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের কোল শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও তাই ধারণ করার চেষ্টা করে। হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক নবজাতক স্বভাবধর্মের (ইসলাম) ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজক বানান।’ (বুখারি, ১৩১৯)
পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের নাম যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আবাসস্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরতি রাখতে সক্ষম।
নৈতিকতা এমন ধরনের উন্নত আচরণ শিক্ষা দেয় যার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে ভালো-মন্দ পার্থক্যবোধের সৃষ্টি হয় এবং যা তাকে সমাজে অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য বা কাক্ষিত আচরণে অভ্যস্ত করে তোলে। সত্যবাদিতা, সাহসিকতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা, অনুগ্রহ, সহানুভূতি, সুবিচার, ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য বা সংযম শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি, দৃঢ়তা, উচ্চাশা, ভ্রাতৃত্ব, স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলির অন্তর্গত। আর পরিবার থেকেই শুরু হয় নৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রখ্যাত দার্শনিক জেবি হল বলেছেন, ‘If you give your children 3 R : Reading, Writing and Arithmetic and you will not give them 4 R- Religion, they will become the 5th R- Rascal…’
শিশুসন্তানের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি যতটা যত্ন নেয়া পরিবারের দায়িত্ব তার চেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান থাকা বাঞ্ছনীয়। হাদিসে এসেছে, মানুষের শরীরে এমন একটি জিনিস আছে, যা অসুস্থ হলে গোটা দেহই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং যা সুস্থ থাকলে গোটা দেহই সুস্থ থাকে সেটা হচ্ছে কল্ব বা অন্তঃকরণ। আর মানুষের যাবতীয় সৎ ও অসৎ গুণাবলি অন্তঃকরণের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পরিবার হচ্ছে সমাজজীবনের ভিত্তিপ্রস্তর। পরিবারই সামাজিক ও নৈতিক শিার সূচনা। পরিবারকে সমাজ দেহের হার্টের সাথে তুলনা করা চলে। এই হার্ট যদি দুর্বল বা বিকল হয়ে পড়ে তাহলে পুরো সমাজব্যবস্থাই বিকল হয়ে যাবে। সমাজজীবনের মূল্যবোধের যত অবয় ঘটেছে তার অধিকাংশেরই কারণ বিশ্লেষণে দুর্বল পারিবারিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়।
পরিবার শিশুর প্রাথমিক ও নৈতিক শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পাদপীঠ। এখান থেকেই তার চরিত্রের ভিত্তি গড়ে উঠে। তাই পরিবারে মা-বাবার প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।’ (সূরা আত-তাহরিম-৬ )
অতএব সন্তানকে আদর্শ শিক্ষাদান ও ইসলামী বিধান পালনে অভ্যস্ত করে তোলা মা-বাবার কর্তব্য ও সন্তানের অধিকার। রাসূল সা. বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয়ে শিক্ষা দাও। ক. তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা; খ. তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা এবং গ. কুরআন তিলাওয়াত।’ (জামিউল আহাদিস : ৯৬১)
সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের রাসূলের যুদ্ধের ইতিহাস শিক্ষা দিতাম, যেমনিভাবে তাদেরকে আমরা কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতাম। ইমাম গাজ্জালি রহ. তার ইহইয়াউ উলুমিদ্দিনের মধ্যে শিশুকে কুরআনুল কারিম, হাদিস, পুণ্যবানদের জীবনকথা ও তারপর দ্বীনের বিধিবিধান শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই সন্তানের মধ্যে আল্লাহর ভয় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই বলতে হবে তুমি যা করো এবং বলো প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে, দিনের আলোতে কিংবা রাতের অন্ধকারে, জলে কিংবা স্থলে সব জায়গায়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাকে পর্যবেক্ষণ করেন। অতএব, আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো অপরাধ করলেও আল্লাহ তোমার কৃতকর্মের হিসাব অবশ্যই নেবেন। তোমাকে তাই সবসময় আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহর পথে চলতে হবে। সন্তানের মধ্যে খোদাভীতির এই চেতনা সঞ্চারিত করতে পারলে সে আর কুপথে পা বাড়াবে না। সন্তানকে শিক্ষাদান প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, ‘উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোনো বাবা তার সন্তানের জন্য করতে পারেনি।’ (তিরমিজি-২০৭৯) তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের ভালোবাসা দাও এবং তাদেরকে সর্বোত্তম শিষ্টাচার ও নৈতিকতা শিক্ষা দাও।’ (ইবনু মাজাহ-৩৮০২) ‘বাবার ওপর সন্তানের হক হলো, তার জন্য সুন্দর একটা নাম রাখবে এবং তাকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও চরিত্রগুণে গড়ে তুলবে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-১২৮২৯)। সন্তানকে একটা উত্তম শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দেয়া আল্লাহর পথে এক সা’ পরিমাণ বস্তু সদকা করার চেয়েও উত্তম।’ (তিরমিজি-২০৭৮)
মা-বাবার সদুপদেশ সন্তানের জীবন পথের পাথেয়। এটি শিশুর উর্বর হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে থাকে সারাজীবন। জীবনের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এগুলোই তাকে সঠিক নির্দেশনা দেয়। ইবনু আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি একদা রাসূল সা.-এর পেছনে আরোহণ করেছিলাম। তিনি বললেন, ‘হে বালক, আমি তোমাকে কিছু (মূল্যবান) কথা শিক্ষা দেবো- তুমি আল্লাহ তায়ালার হক আদায়ের ব্যাপারে যত্নশীল হও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের অনিষ্ট থেকে হিফাজত করবেন। যখন কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছেই করবে। যখন সাহায্যের আবেদন করবে, তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই করবে। জেনে রাখো, যদি গোটা জাতি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তাহলে তারা ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য বরাদ্দ করেছেন। আর তারা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তাহলে ততটুকুই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তোমার নামে বরাদ্দ করেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে আর নিবন্ধন বই শুকিয়ে গেছে অর্থাৎ তাকদিরে যা বরাদ্দ হওয়ার তা হয়ে গেছে।’ (তিরমিজি-২০৭৬)
অতএব, সমাজ জীবনকে সুস্থ ও সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করে গড়ে তুলতে সবার উচিত পারিবারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন মা। আরবি কবি হাফেজ ইবরাহিম উত্তম জাতি গঠনে মায়ের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, ‘মা হলেন জ্ঞানালোকের প্রথম বাতি। তাকে যদি গড়তে পারো, জন্ম নেবে সত্য জাতি।’
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় , কুষ্টিয়া