Home বিশ্ব করোনায় হাসপাতালে ট্রাম্প : নির্বাচন পূর্ব সংকটে যুক্তরাষ্ট্র

করোনায় হাসপাতালে ট্রাম্প : নির্বাচন পূর্ব সংকটে যুক্তরাষ্ট্র

by Newsroom
সংকটে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে রাত প্রায় ১টা, ডোনাল্ড  ট্রাম্প টুইট করলেন যখন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই তখন গভীর ঘুমে। ২ অক্টোবর শুক্রবার সকালে উঠেই তারা জানলেন তাদের দেশে প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। আর এমন একটি সময়ে এই খবর এসেছে, যখন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি মাত্র ৩৩ দিন।

করোনায় দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু দেখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ও প্রেসিডেন্টের আক্রান্ত হওয়ার খবর একটি বড় ধাক্কাই বটে। ট্রাম্প মারা গেলে বা দায়িত্ব পালনে কি হবে? সে নিয়েও চলছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে নানা আলোচনা।

যদিও ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় ২ অক্টোবর শুক্রবার সকালে হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ মার্ক মিডোস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর একজন মানুষ। তবে সকাল থেকে তার মধ্যে কোভিড-১৯ এর ‘মৃদু’ উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমাদের প্রেসিডেন্ট এই অবস্থাতেও জাতির জন্য কাজ করে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি তার কাজ করছেন এবং কাজের মধ্যেই থাকবেন। আমি আশাবাদী, তিনি খুব দ্রুত, খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

তবে হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে দুজনের কোয়ারেন্টিন শুরুর খবর জানিয়ে ট্রাম্প তার টুইটে আত্মবিশ্বাসের সুরেই লিখেছেন, “আমরা একসঙ্গেই এটা কাটিয়ে উঠব।”

টুইট করেছেন মেলানিয়াও লিখছেন, তাদের উপসর্গ খুবই মৃদু, এমনিতে ভালোই আছেন।

ট্রাম্পের চিকিৎসক শন কনলি পরে এক বিবৃতিতে বলেন, প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি দুজনেই আপাতত ভালো আছেন। সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজে নিজেদের ঘরেই থাকার পরিকল্পনা করেছেন তারা। আমি আশা করছি, সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেও প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্ব নির্বিঘ্নেই চালিয়ে যেতে পারবেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি আমি নিয়মিত আপনাদের জানাবো।’

এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মাস্ক পরতে কমই দেখা গেছে; অন্যরা মাস্ক পরলে রসিকতা করতেও তিনি ছাড়েননি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেভাবে করোনাভাইরাস মহামারী সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা- দুদিক দিয়েই বিশ্বে এখন সবার উপরে যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প আশা করছিলেন, হোয়াইট হাউজের ভিতরে সবার নিয়মিত পরীক্ষা করা হলেই হয়ত তিনি ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে পারবেন। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি নিজে মাস্ক পরার পক্ষপাতী ছিলেন না।

আরও পড়ুন- করোনা পজিটিভ ডোনাল্ড ট্রাম্প হাসাপাতালে

সিএনএন লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুক্রবার প্রথম প্রহরে টুইট করে নিজের এবং তার স্ত্রী মেলানিয়ার সংক্রমণ ধরা পড়ার যে খবর দিয়েছেন, তা ঘটনাপ্রবাহে নাটকীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

রাষ্ট্রের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে দিনের পর দিন করোনা ভাইরাসের বিপদকে ‘খাটো করে দেখিয়ে এসেছেন’ ট্রাম্প। দেশ যখন এমনিতেই সঙ্কটে জর্জরিত, তার সংক্রমিত হওয়ার খবর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘নতুন সঙ্কটের ঝুঁকি’ তৈরি করছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্কদের ঝুঁকিই সবচেয়ে বেশি। ৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্প সেই বয়স শ্রেণিতেই পড়েছেন। আর মেলানিয়ার বয়স ৫০ বছর।

এদিকে সঙ্কটের খবর দিয়ে সিএনএন লিখেছে, রাষ্ট্রের প্রথম দম্পতির এই আশাবাদী সুর ‘ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার শঙ্কাকে’ চাপা দিতে পারছে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে এখন লড়তে হচ্ছে প্রজন্মের একটি বড় সঙ্কটের সঙ্গে। দেশের রাজনীতি চলে গেছে স্মরণকালের মধ্যে বাজে একটি পর্যায়ে। ওই খবরে শেয়ার বাজারেও দরপতন হয়েছে।

সিএনএন লিখেছে, হোয়াইট হাউজে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রেসিডেন্টের কাছের উঁচু পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কারা কারা আক্রান্ত হলেন, তা বোঝার চেষ্টা চলছে। সাধারণত হোয়াইট হাউজে প্রতিদিন সব উপদেষ্টা এবং যারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংস্পর্শে আসেন তাদের সবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়।

৩ নভেম্বর ভোট সামনে রেখে গত কয়েক সপ্তাহে নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সফর করে আসছিলেন ট্রাম্প। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেই তিনি হাজারো মানুষের ভিড়ের মধ্যে রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে যোগ দিচ্ছিলেন।

নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিতে গত মঙ্গলবার ট্রাম্প গিয়েছিলেন ওহাইওতে। ‘এয়ার ফোর্স ওয়ানে’ তার সঙ্গে ছিলেন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হোপ হিকস। পরদিন বুধবার একটি নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নিতে হেলিকপ্টারে করে মিনেসোটায় যান ট্রাম্প। সেখানেও হিকস তার সঙ্গে ছিলেন।

পরদিনই হোয়াইট হাউস জানতে পারে, হিকস করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। সে খবরে হোয়াইট হাউজে তোলপাড় শুরু হলেও বেশ কিছু সময় সে খবর গোপন রাখে ট্রাম্প কর্মকর্তারা।

ট্রাম্প নিজেই আক্রান্ত হওয়ার পর তার মন্ত্রিসভার সদস্য আর আশপাশের লোকজনের পরীক্ষা করার হিড়িক পড়ে গেছে।

ওহাইওতে নির্বাচনী বিতর্কে ট্রাম্পের সঙ্গে একই মঞ্চে ছিলেন তার প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন। ট্রাম্পের পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসার পর অনেকেই গুগলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন বাইডেনের খোঁজ জানার জন্য।

তবে শুক্রবার পরীক্ষার পর জানা গেছে, বাইডেন এ যাত্রা সংক্রমিত হননি। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং তার স্ত্রীর করোনাভাইস পরীক্ষার ফলও ‘নেগেটিভ’ এসেছে।

প্রেসিডেন্টের মেয়ে ইভাঙ্কা, জামাতা জারেড কুশনার এবং ট্রাম্প-মেলানিয়ার ১৪ বছর বয়সী ছেলে ব্যারনের করোনাভাইরাস পরীক্ষাতেও সংক্রমণ ধরা পড়েনি বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ।

চিঠি

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, হিকসের সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি জানার পরও কেন ট্রাম্প ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার নিউ জার্সিতে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহসহ কর্মসূচি এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলেন।

নিউ জার্সির ওই অনুষ্ঠানে শত শত সমর্থক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংস্পর্শে আসবেন, এটা জানার পরও হোয়াইট হাউজ কেন ওই অনুষ্ঠান চালিয়ে নিতে দিল, সেই প্রশ্ন এসেছে সিএনএন এর প্রতিবেদনে।

নিউ জার্সির ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজনকে উদ্ধৃত করে সিএনএন লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সেখানে কিছুটা বিমর্ষ দেখাচ্ছিল, কণ্ঠও কিছুটা কর্কশ শোনাচ্ছিল। তবে তারা ভেবেছিলেন, ভোটের প্রচারের টানা সফরে তিনি হয়ত ক্লান্ত।

নিউ জার্সিতে ট্রাম্প একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন, যেখানে বসার ক্ষেত্রে দূরত্ব রাখা হলেও কারও মুখে মাস্ক ছিল না। পরে বাইরে খোলা জায়গায় পডিয়ামের পেছনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বক্তৃতাও দেন। সেখানেও অধিকাংশের মুখে মাস্ক ছিল না।

সংক্রমণ এড়াতে চিকিৎসকরা যেখানে মাস্ক ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে মাস্ক পরতে অনাগ্রহ দেখিয়ে এসেছেন, এমনকি যারা মাস্ক পরছেন, তাদেরও সমালোচনা করতে ছাড়েননি।

যদিও বৃহস্পতিবারও এক ভোজসভায় তিনি বলেন, শিগগিরই মহামারীর অবসান হতে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।

তবে হোয়াইট হাউজের আরও অনেকের মধ্যেই যে ইতোমধ্যে সংক্রমণ ঘটে থাকতে পারে, সে কথা স্বীকার করেছেন মিডোস।

হোয়াইট হাউজের কর্মীদের মধ্যে যারা ওই কম্পাউন্ডে থাকেন, তাদের মধ্যেও কাজ করছে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা। একজন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, হোয়াইট হাউজের ভেতরে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটা যতটা পারা যায় টেলিফোনেই সারতে বলা হয়েছে তাদের, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ সংস্পর্শ এড়ানো যায়।

সিএনএন লিখেছে, প্রেসিডেন্টের শুক্রবারের কর্মসূচিতে এই পরিবর্তনই বলে দিচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচার কতটা বদলে যাবে।

আইসোলেশনে থাকা ট্রাম্প আগামী বেশ কিছুদিন পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটের প্রচারে সশরীরে অংশ নিতে পারবেন না।

আগামী ১৫ অক্টোবর ফ্লোরিডার মিয়ামিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে দ্বিতীয় টেলিভিশন বিতর্কের কী হবে তাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

ফলে মহামারী এবং তা সামলাতে সরকারের ব্যর্থতা থেকে ভোটারদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর সুযোগ ট্রাম্প খুব একটা পাবেন না, যা তার ভোটেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে সিএনএন।

এখন ট্রাম্পের অসুস্থতা গুরুতর দিকে মোড় নিলে কী ঘটতে পারে, সে আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে।

যদি ট্রাম্প অসুস্থতার কারণে সরকার পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী তিনি অস্থায়ীভাবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারবেন এবং কাজে ফেরার মত সুস্থ হয়ে আবার নিজের হাতে দায়িত্ব তুলে নিতে পারবেন।

চিকিৎসার প্রয়োজনে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দুইবার এভাবে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন। এছাড়া, অস্ত্রোপচারের কারণে রোনাল্ড রিগ্যানও একবার ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

যদি ট্রাম্পের বেলায় জরুরি প্রয়োজনে এমন কিছু করতে হয়, তাহলে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভা দায়িত্ব হস্তান্তরের উদ্যোগ নিতে পারবে।

এমনকি প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট দুজনও যদি কোনো কারণে মারা যান বা একসঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন, সেক্ষেত্রে কী করতে হবে তাও সংবিধানে বলা আছে।

জর্জ মাসন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ইলিয়া সমিন বলেন, “সেরকম পরিস্থিতিতে কার হাতে ক্ষমতা যাবে সেটা সংবিধানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে। এরকম হলে হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন।”

পরিস্থিতি যদি তেমনই হয় এবং বিরোধীদল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা ন্যান্সি পেলোসিকে যদি ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়, তবে আইনে যতই সেই ব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকুক, ‘বিশৃঙ্খলা নিশ্চিত’ বলে সতর্ক করছেন বিশ্লেষকরা।

ভয়েস টিভি/ডিএইচ

You may also like