বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যখন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান চলছিল, তখন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় কাঁদছিলেন প্রখ্যাত চিত্রনায়িকা কহিনূর আক্তার সুচন্দা। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য এবারের আসরে তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ার কারণে সুচন্দা উপস্থিত থাকতে পারেননি অনুষ্ঠানে।
তাই তার খুব দুঃখ। আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্তির খবরটি শোনার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে কিছু কথা বলার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী। কিন্তু করোনার কারণে অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থাকতে না পারলেও গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
সুচন্দা বললেন, ‘আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্তরা অনুভূতি ব্যক্ত করেন। ভেবেছিলাম, আমিও কিছু কথা বলব। কিন্তু এর মধ্যে অসুস্থতার কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। আমি যেতে পারিনি। তারপরও আমার ও জহির রায়হানের ছেলে আরাফাত রায়হান আমার অনুভূতিটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পড়ে শোনানোর কথা ছিল। আমি চিঠি আকারে তা লিখেও দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত তা না শোনাতে পারায় খুবই কষ্ট পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ও জহির রায়হানের অসাধারণ স্মৃতির কথা পড়ে শোনানোর ইচ্ছা ছিল, যা সবারই অজানা।’
বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি। নিপুণ অভিনয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছিলেন বড় একটা সময় ধরে। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেও দেখিয়েছেন নৈপুণ্য। মুগ্ধতায় ভাসিয়েছেন দর্শক-সমালোচকদের। তিনি সুচন্দা। কোহিনুর আক্তার সুচন্দা।
দেশভাগের বছর তথা ১৯৪৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যশোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা ছিলেন চিকিৎসক। সুচন্দার দুই বোনের নাম ফরিদা আক্তার পপি, যিনি ববিতা নামে পরিচিত এবং দেশের বিখ্যাত অভিনেত্রী। আরেক বোনের নাম গুলশান আরা আক্তার চম্পা। তিনিও বাংলা চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনেত্রী।
শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে সুচন্দা। যার ফলে ছোট বেলা থেকেই সংস্কৃতির চর্চায় মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন তিনি। গান শেখা, নাচ শেখা, ছবি আঁকা এসবে দারুণ সমৃদ্ধ ছিল সুচন্দার শৈশব। সুচন্দা পড়াশোনা করেছেন যশোর মোমেন গার্লস স্কুলে। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। এরপর মাইকেল মদুসূদন কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট ও উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
আরও পড়ুন : সাদেক বাচ্চুর স্মরণে শাপলা মিডিয়ার দোয়া মাহফিল
অভিনয় ভুবনে সুচন্দার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৫ সালে। প্রখ্যাত অভিনেতা কাজী খালের একটি প্রামাণ্যচিত্র দিয়েই সেই সূচনা। এরপর চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয় খ্যাতিমান নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘কাগজের নৌকা’ সিনেমা দিয়ে। সেটা ১৯৬৬ সালের কথা।
দ্বিতীয় সিনেমাতেই সুচন্দা অভিনয় করেন বাংলা চলচ্চিত্রের নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে। সিনেমার নাম ‘বেহুলা’। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই সিনেমায় অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন সুচন্দা। ‘বেহুলা’ সিনেমা সুচন্দার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন কিংবদন্তি লেখক ও নির্মাতা জহির রায়হান। সুচন্দার সঙ্গে আলাপ করেন, তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। এরপর ভালোলাগা আর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে তারা বিয়ে করেন ১৯৬৮ সালে।
পরবর্তীতে জহির রায়হানের বিখ্যাত সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’তে অভিনয় করেছেন সুচন্দা। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। কিন্তু এর এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জহির রায়হান ও সুচন্দার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
সুচন্দা অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জীবন থেকে নেওয়া’, ‘কলমিলতা’, সংগ্রাম’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, নয়নতারা’, ‘মনের মত বউ’, ‘প্রতিশোধ’, ‘নতুন নামে ডাকো’, ‘কোথায় যেন দেখেছি’, ‘জুলেখা’, ‘বিচার’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘তিন কন্যা’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘রাখাল বন্ধু’, ‘তৃষ্ণা’, ‘দোষী’ ইত্যাদি।
এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি উর্দু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। যেমন- ‘যাহা বাজে সাহনাই’, ‘পিয়াসা’, হাম এক হায়’, ইত্যাদি। ‘হাম এক হ্যায়’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি পাকিস্তান থেকে নিগার পুরস্কার পেয়েছিলেন।
অভিনয়ে তুমুল সাফল্যের পর সুচন্দা নাম লেখান প্রযোজনায়। ‘সুচন্দা চলচ্চিত্র’ ব্যানারে তিনি প্রযোজনা করেছেন ‘টাকা আনা পাই’, ‘প্রতিশোধ’, ‘তিন কন্যা’, ‘বেহুলা-লখিন্দর’, ‘বাসনা’, ‘প্রেমপ্রীতি’, সবুজকোট’, কালো চশমা’, ‘হাজার বছর ধরে’ ইত্যাদি সিনেমাগুলো।
সুচন্দা প্রযোজিত ‘তিন কন্যা’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। এই সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিল। এছাড়া তিনি ‘হাজার বছর ধরে’ সিনেমাটি নির্মাণের জন্যও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সুচন্দা কেবল একটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই একটি সিনেমাই যথেষ্ট। এই সিনেমার নাম ‘হাজার বছর ধরে’। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান, রিয়াজ ও শশী প্রমুখ। সিনেমাটি দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ৬টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতেছিল।
ভয়েস টিভি/ডিএইচ