Home শিক্ষাঙ্গন ইবির ভাস্কর্যে ৭১’র স্মৃতি

ইবির ভাস্কর্যে ৭১’র স্মৃতি

by Shohag Ferdaus
ইবি

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির সর্বকালের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফসল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো বাঙালি অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন দেশের জন্য। দেশের জন্যে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকেই। বাঙালির সাহিত্যকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। এ দেশীয় ভাস্কর্য শিল্পও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। বাঙালির শ্রেষ্ঠ এই সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক।

মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্দেশ্য দুটো- একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি সম্মান জানানো পাশাপাশি একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখার জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও (ইবি) রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক ভাস্কর্য ‘মুক্তবাংলা’ ও ‘শহীদ স্মৃতিসৌধ’। এছাড়া রয়েছে মু্ক্তির আহ্বান, শাশ্বত মুজিব ও মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা সংগ্রামের ইতহাস নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করতে তৈরি করা হয় এসব ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে।

মুক্তবাংলা

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গল্পগুলোর স্মরণে এবং শহীদদের প্রতি মর্যাদার প্রতীক হয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তবাংলা। ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইবি’র প্রশাসনিক ভবনের পূর্ব পাশে স্থাপন করা হয় ‘মুক্তবাংলা’। যার নকশা করেন রশিদ আহমেদ। এ ‘মুক্তবাংলা’য় সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ রাইফেল, যা সাত সদস্যের মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রতীক।

ওপর থেকে চতুর্থ ধাপে লাল সিরামিক ইট আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রতীক, দ্বিতীয় ধাপে কালো পাথর শোক ও দুঃখের প্রতীক, তৃতীয় ধাপে সাদা মোজাইক সন্ধি ও যোগাযোগের প্রতীক এবং বেদির মূল মেঝে সবুজ মোজাইকের নীল টাইলস শান্তির প্রতীক। সম্পূর্ণ অবকাঠামোটি সাতটি আর্চ সম্বলিত একটি অর্ধ উদিত (উদিয়মান) সূর্য। মুক্তবাংলা একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয় তেমনি শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।

শহীদ স্মৃতিসৌধ

বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার লীলাভূমিতে রূপান্তরের প্রত্যয়ে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত করতে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিসৌধ। ২০০১ সালে নির্মিত হয় ‘শহীদ স্মৃতিসৌধটি। এটি সবার নজর কাড়ে। এ সৌধটি ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শহীদদের স্মরণ করিয় দেয় হয়। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী হাশেম খান এবং প্রখ্যাত স্থাপত্যবিদ রবিউল ইসলামের দেয়া মডেল ও স্থাপত্য কর্মের ভিত্তিতে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়।

ইবি

৭১ ফুট উঁচু পরিসরে তিন ফুট ৯ ইঞ্চি থেকে পাঁচ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার ইটের চত্বরে এই স্তম্ভটি স্থাপিত। যার ওপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ,পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের বেদি, প্রশস্ত পাটাতন, মাঝখানে ২১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট জাতীয় পতাকার দন্ড এবং দুই পাশে ১০ ফুট উচ্চতার ৩৮ ফুট ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে দুটি দেয়ালচিত্র সন্নিবেশ করা হয়েছে।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মরমী সাধক ফকির সম্রাট লালন শাহ, পাগলা কানাই ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণী সংযোজন স্মৃতিসৌধটির গুরুত্ব আরও অর্থবহ করে তুলেছে। এছাড়া গোলাকার জ্যামিতিক বৃত্ত, ব্যাসার্ধ, স্তম্ভ ইত্যাদি স্থাপত্য দেশের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়।

মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব

বাঙালির এই মহান আন্দোলনের যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীন বাংলাদেশ এক অপরের পরিপূরক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে সামনে তাকালেই চোখে পড়বে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি স্মরণে নির্মিত মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালটি।

ইবি

২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ ম্যুরালটি উদ্বোধন করেন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধারণ করা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যুরালটি গুগল সার্চে শীর্ষে রয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতির পিতার আদর্শ সঞ্চারিত হবে বলে আশা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃষকের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা

৩১ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৭ ফুট প্রস্থের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। মূল বেদির ওপর আড়াই ফুট উঁচু ও ২০ ফুট চওড়া বেদি আছে। যেখানে বিভিন্ন দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়। আর মূল প্রতিকৃতির ডান দিকে চার ফুট চওড়া ও ২০ ফুট উঁচু প্রাচীরে লেখা আছে ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত এই বাণী আমাদের দেশপ্রেম বাড়িয়ে তোলে।

মুক্তির আহ্বান

বঙ্গবন্ধুর যে কয়েকটি বাক্য পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তা ছিল ৭ মার্চের ভাষণ। বলা হয়ে থাকে এ ভাষণের মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহীত ছিল। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত ৭ই মার্চের ভাষণ সম্বলিত মুক্তির আহ্বান ম্যুরালে কথা।

ইবি

এটি একটি অন্যান্য স্থাপনা। ৯ ফুট উচ্চতা ও ১৮ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট ৭ মার্চের ভাষণ সম্বলিত ‘মুক্তির আহ্বান’ ম্যুরালটি দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাস নিয়ে। এটি ২০২০ সালের ২৬ মার্চ উদ্বোধন করা হয়। ম্যুরালটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ফটকেই অবস্থিত।

শ্বাশত মুজিব

মুক্তির আহ্বান ম্যুরালের ঠিক বিপরীত দিকে নির্মিত হয়েছে শ্বাশত মুজিব ম্যুরাল। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হলের ফটকের দুই পাশে দুটি ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছে। এ ম্যুরাল দুটি হলের মহত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।

ইবি

শ্বাশত মুজিব ম্যুরালটি সাড়ে ১০ ফুট উচ্চতা ও ৭ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট। এ ম্যুরালটিও দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি জীবনের আলোর দিশারী হিসেবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তত্ত্বাবধানে এর নকশা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক।

আরও পড়ুন: অযত্ন-অবহেলায় পাবনার মুক্তিযুদ্ধের একাধিক স্মৃতিস্তম্ভ

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like