বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। মসজিদের শহর ঢাকার ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। প্রাচীন এই শহরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। ফলে চারদিক থেকে ভেসে আসে আজানের মধুর সুর। সেজন্যই ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। মূলত মুঘল আমল থেকেই মসজিদের শহরে পরিণত হয় ঢাকা। আধুনিক স্থপত্য বিদ্যায় তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন মসজিদ, তবে প্রাচীন আমলের অনেক মসজিদ এখনো বিদ্যমান ঢাকা শহরে। মুঘল আমলের অনিন্দ্য সুন্দর স্থপত্য কলায় নির্মিত মসজিদগুলো দেখে এখনো মানুষ বিমোহিত হয়। রাজধানীর প্রাচীন দশটি মসজিদ নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।
বিনত বিবির মসজিদ
পুরনো ঢাকার নারিন্দা এলাকায় অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদ। ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। ৮৬১ হিজরি বা ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে মারহামাতের কন্যা মুসাম্মাত বখত বিনত বিবি এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি চৌকোনা, এবং এতে দুইটি গম্বুজ ও চারটি মিনার রয়েছে। এই মসজিদটি ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন মুসলিম স্থাপনার নিদর্শন হিসাবে অনুমিত।
চক বাজার শাহী মসজিদ
পুরান ঢাকার চকবাজারে অবস্থিত মুঘল আমলে নির্মিত শাহী মসজিদ। মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান এটিকে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। তিনটি গম্বুজ আর বিশাল মিনার এ মসজিদটির মূল আকর্ষণ। এই মসজিদটিই সম্ভবত বাংলায় উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত প্রাচীনতম ইমারত-স্থাপনা। প্লাটফর্মটির নিচে ভল্ট ঢাকা কতগুলো বর্গাকৃতি ও আয়তাকৃতি কক্ষ আছে। এগুলোর মাথার উপরে খিলান ছাদ রয়েছে, যার উপরের অংশ অবশ্য সমান্তরাল।
কর্তালাব খান মসজিদ
পুরান ঢাকার বেগম বাজারে অবস্থিত কর্তালাব খান মসজিদটি বেগম বাজার মসজিদ নামেও পরিচিত। ১৭০১ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে নির্মিত এই মসজিদটি তৎকালীন দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের নামে করা হয়। মুর্শিদ কুলি খান কর্তালাব খান নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের পুরনো স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ এটি। রয়েছে আকর্ষণীয় পাঁচটি গম্বুজ। অষ্টভূজাকৃতির গম্বুজগুলো পদ্ম ও কলসচূড়ায় শোভিত।
তারা মসজিদ
পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত ঐতিহাসিক তারা মসজিদ। আঠারো শতকের শুরুর দিকে মির্জা গোলাম পীর নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এ মসজিদ নির্মাণ করেন। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এই স্থাপনাটি মনোমুগ্ধকর। ১৯২৬ সালে তারা মসজিদ সংস্কারের উদ্যোগ নেন ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান ব্যাপারী। সেই সময় মোজাইক কারুকাজে ব্যবহৃত হয় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ।
মুসা খান মসজিদ
মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার বারো শাসককে বলা হয় ‘বারো ভূঁইয়া’। আর তাদের আমলেই বাংলায় নির্মিত হয় চমৎকার সব স্থাপত্য। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে মুসা খাঁর মসজিদ। এটি নির্মিত হয় আনুমানিক ১৬৭৯ সালে। ধারণা করা হয় যে, মসজিদটি ঈশা খাঁ’র পুত্র মুসা খান নির্মাণ করেন। এ মসজিদ প্রাক-মুঘল স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। কার্জন হলের চত্বরটি একসময় ‘বাগে-মুসা খান’ বা মুসা খানের বাগান নামেই পরিচিত ছিল।
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত হাজী শাহবাজ মসজিদটি। মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। হাজী শাহবাজ নামে একজন অভিজাত ধনী ব্যবসায়ী এটি নির্মাণ করেন।
লালবাগ শাহী মসজিদ
ঢাকার লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত লালবাগ শাহী মসজিদ। প্রাচীন এই মসজিদটি ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকার উপ-শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফর্রুখশিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়।
খান মহম্মদ মৃধার মসজিদ
পুরান ঢাকার লালবাগের আতশখানায় অবস্থিত খান মহম্মদ মৃধার মসজিদ। প্রাচীন এই মসজিদটি ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে নায়েবে নাযিম ফররুখশিয়ারের শাসনামলে ঢাকার প্রধান কাজী ইবাদুল্লাহ’র আদেশে খান মহম্মদ মৃধা নির্মাণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
কসাইটুলি মসজিদ
পুরান ঢাকার কসাইটুলির কে পি ঘোষ রোডে অবস্থিত কসাইটুলি মসজিদ। এ মসজিদটি ‘কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ’ নামে পরিচিত। এর আরেক নাম ‘চিনির টুকরা মসজিদ’। হিজরি ১৩৩৮ সনে জনৈক ব্যবসায়ী আবদুল বারি এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
পুরান ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে ১৯৫৯ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন তৎকালীন ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের মূল অবকাঠামো মক্কা শরীফ এর কাবা এর মতো। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ।
ভয়েস টিভি/এসএফ