পৃথিবীর ইতিহাসে স্পেনে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে। ৭১১ সালের ২৬ এপ্রিল সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের মাত্র সাত হাজার সৈন্য রাজা রডারিকের প্রায় এক লাখ সৈন্যের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হন। সেই ৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৮০০ বছর স্পেন শাসন করে মুসলমানরা। মুসলিম শাসনামলে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় স্পেন। সেই সময় স্পেনে তৈরি বিভিন্ন মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শন আজও বিশ্বের বিস্ময়। তেমনি এক বিস্ময় হলো কর্ডোভা মসজিদ। তবে সেই মসজিদে এখন আর নামাজ আদায় না বরং খিস্টানরা সেখানে উপাসনা করেন। আজানের সুমধুর ধ্বনির পরিবর্তে মসিজাদের মিনার থেকে ভেসে আসে ঘণ্টাধ্বনি। ত্রয়োদশ শতকে সেই মসজিদটিকে রানী ইসাবেলা গীর্জায় পরিণত করেন। মসজিদটির স্থাপত্য শৈলীতে আজও বিমোহিত বিশ্ব।
খলিফা প্রথম আব্দুর রাহমানের শাসনামলে ৭৮৪ থেকে ৭৮৬ সালে আন্দালুসিয়ার কর্ডোভায় নির্মিত হয় ঐতিহাসিক কর্ডোভা মসজিদটি। পরে অন্যান্য শাসকের মাধ্যমে মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন ঘটে। স্প্যানিশ ভাষায় মসজিদকে বলা হয় ‘মেজিকেতা’। তাই স্প্যানিশ ভাষায় এই মসজিদ লা মেজিকেতা নামে পরিচিত। কর্ডোভা মসজিদটি মুরিশ স্থাপত্যের সর্বাপেক্ষা নিখুঁত স্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি। স্থাপনের পর প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন মুসলমানরা। সে সময় মসজিদটি ইসলামি শিক্ষা, শরিয়া আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তারপর ক্যাসলের রাজা তৃতীয় ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের পরাজিত করে স্পেন দখল করলে বাঁক নেই ইতিহাস।
১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের মসজিদটির নকশা করেন একজন সিরিয়ান স্থপতি। এর থামের সংখ্যা ৮৫৬টি। এছাড়াও ৯টি বাহির দরজা ও ১১টি অভ্যন্তরীণ দরজা রয়েছে। লাল ডোরাকাটা খিলানগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় স্থাপত্যশিল্পে মুসলিম পাণ্ডিত্যের কথা।
অনিন্দ্য সুন্দর এই মসজিদের থামগুলো নির্মিত হয়েছে মার্বেল, গ্রানাইট, জেসপার, অনিক্স পাথর দিয়ে। পরে নতুন করে সংস্কার করে সোনা, রুপা ও তামাসহ অনেক মূল্যবান উপাদান ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য আরও বাড়ানো হয়।
কর্ডোভা মসজিদ নির্মাণে সেকালেই আড়াই থেকে তিন লাখ মুদ্রা ব্যয় করা হয়েছিল। পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ছিল ৫০০ ফুট। এর সুন্দর ও আকর্ষণীয় মিহরাবগুলো স্থাপিত ছিল পাথরের নির্মিত এক হাজার ৪১৭টি স্তম্ভের ওপর। মিহরাবের কাছে একটি উঁচু মিম্বর ছিল হাতির দাঁত ও ৩৬ হাজার বিভিন্ন রং ও বিভিন্ন কাষ্ঠ খণ্ডের তৈরি। সেগুলোর ওপর ছিল হরেক ধরনের হীরা-জহরতের কারুকাজ। দীর্ঘ সাত বছরের পরিশ্রমে মিম্বরটি নির্মাণ করা হয়। তৈরি করা হয় ১০৮ ফুট উঁচু মিনার, যাতে ওঠানামার জন্য নির্মিত দুটি সিঁড়ির ছিল ১০৭টি ধাপ। মসজিদের মধ্যে ছোট-বড় ১০ হাজার ঝাড়বাতি জ্বালানো হতো। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ঝাড়বাতি ছিল রুপার, বাকিগুলো পিতলের তৈরি। বড় বড় ঝাড়ের মধ্যে এক হাজার ৪৮০টি প্রদীপ জ্বালানো হতো। শুধু তিনটি রুপার ঝাড়েই ৩৬ সের তেল পোড়ানো হতো। ৩০০ কর্মচারী ও খাদেম শুধু এই মসজিদের তদারকিতেই নিয়োজিত ছিলেন।
মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আন্দালুসিয়াকে বিভক্ত করে ফেলে। মুসলমানদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্যাসলের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা ১২৩৬ সালে স্পেন দখল করলে এই মসজিদকে গির্জায় পরিণত করা হয়। তখন থেকে একে বলা হয় দ্য মস্ক ক্যাথেড্রাল অব কর্ডোভা।
মসজিদটিতে সুউচ্চ চারকোনা আকৃতির একটি মিনার নির্মাণ করেছিলেন খলিফা তৃতীয় আব্দুর রাহমান। এক সময় সুন্দর সেই মিনার থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি। কিন্তু গির্জায় রূপান্তরিত হওয়ার পর মিনারটিতে অসংখ্য ঘণ্টা লাগানো হয়েছে। মসজিদে ঢুকতেই এখন চোখে পড়বে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি। মসজিদের বিভিন্ন আয়াত ও আল্লাহর নামের ক্যালিওগ্রাফির পরিবর্তে এখন শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন তৈলচিত্রের ক্রিশ্চিয়ান ফলক। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে ও দেয়াল সংলগ্ন অংশে খ্রিস্টধর্মীয় চিত্র ও ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় আলাদা করে গির্জার মঞ্চ ও পুণ্যার্থীদের বসার বেঞ্চ রয়েছে। মঞ্চে শোভিত হচ্ছে যিশুখ্রিস্ট ও সাধুদের ভাস্কর্য।