Home ভিডিও সংবাদ অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ ফকির লালন শাহ্

অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ ফকির লালন শাহ্

by Amir Shohel

মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্। তিনি একাধারে ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ এবং মহাত্মা লালন নামে পরিচিত। লালন ফকিরকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁকে বলা হয় ‘বাউল-সম্রাট’। উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। আর দর্শনও সমাদৃত হতে থাকে মানুষের মাঝে। দিন দিন বেড়েই চলেছে তাঁর অনুসারী বাউল ভক্তদের।

উপমহাদেশের বাউল সাধকদের অন্যতম বিস্ময়কর এই মনিষীর জন্ম ও ধর্ম পরিচয় নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। তবে গবেষকদের দাবি, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

লালন ফকির মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের উর্দ্ধে। এই মরমী সাধক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে যা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিৎ।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ায় এসে বাউল গানে প্রভাবিতও হয়েছিলেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখন পর্যন্ত লালন ফকিরের সহস্রাধিক বাউল গান সংগৃহীত হয়েছে।

জনশ্রুতি আছে, ১৭৯০ সালে তীর্থ ভ্রমণে যাওয়ার সময় গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন লালন। এ সময় তাঁকে মৃত ভেবে নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। ওই ভেলায় ভাসতে ভাসতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামের কালীগঙ্গা নদীর তীরে আটকে যায়। সেসময় নদীতে জল আনতে গিয়ে মতিজান বিবি তীরে আটকে থাকা ভেলাটি দেখতে পান। পরে তাঁর স্বামী মলম শাহকে বিষয়টি জানান। এরপর নদী থেকে লালনকে তুলে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। তাঁদের সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন লালন ফকির। নিঃসন্তান দম্পতি মতিজান বিবি ও মলম শাহ লালনকে তাঁদের পালক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের গৃহের একসময় লালনের নিজস্ব চিন্তা চেতনার বর্হিপ্রকাশ ঘটতে থাকে। হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী এক মানুষ। যা বরাবরই ছিল জাত, ধর্ম, গোত্রের উর্দ্ধে।

পরবর্তীতে লালনের দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে পালক পিতা-মাতাও তাঁর দর্শন গ্রহণ করেন। ভক্ত ও পালক পিতা মলম শাহের দানকৃত জমিতেই ১৮২৩ সালে লালন সাঁইজি ছেঁউড়িয়ায় একটি আখড়া তৈরি করেন। যেখানে তিনি তাঁর ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে অপার সাঁইকে খুঁজে ফেরা এবং বাউল সাধন-ভজনের দীক্ষা দিতে শুরু করেন। তিনি জীবদ্দশায় ছেউড়িয়ায় দোল পূর্ণিমায় একটি উৎসব করতেন। সেখানে তাঁর বিভিন্ন প্রান্তে ভক্ত-শিষ্যরা গানে গানে পাল্টা দিতেন। তখন তাঁর দশ হাজারের বেশি ভক্ত-শিষ্য উৎসবে অংশ নিতেন।

১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর পহেলা কার্তিক ১১৬ বছর বয়সে ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়িতেই দেহত্যাগ করেন বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই। ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়ির মূল আঙিনায় রয়েছে তাঁর সমাধি। এ ছাড়াও সেখানে তাঁর সরাসরি শিষ্য ও ভক্তদের সমাধিও রয়েছে।

প্রতিবছর দোল পূর্ণিমা উৎসব এবং কার্তিক মাসে তিরোধান দিবসে স্মরণ উৎসব উদযাপন করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির তত্ত্বাবধানে এই স্মরণোৎসব আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে আখড়া বাড়ির মূল আঙিনার বাহিরে কালিগঙ্গা নদীর তীরের ফাঁকা মাঠ ছাড়িয়ে পুরো ছেঁউড়িয়া গ্রাম দেশ-বিদেশের লালন ভক্ত অনুসারী ও দর্শনার্থীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। আর এই উৎসব উপলক্ষে কালিগঙ্গা নদীর তীরে বসানো হয় গ্রামীণ মেলা।

লালনের বাউল গানগুলো অমর সৃষ্টি হয়ে অগণিত ভক্ত-অনুসারীদের অন্তরজুড়ে স্থান করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে লালনের দর্শন অনুসরণসহ তাঁর সাধন-ভজনের নানা দিক নিয়ে গবেষণা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like