Home অর্থনীতি পেঁয়াজ উৎপাদনে যেভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে বাংলাদেশ

পেঁয়াজ উৎপাদনে যেভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে বাংলাদেশ

by Shohag Ferdaus
পেঁয়াজ

ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করলেই অস্থির হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার ভারত অল্প কিছু পেঁয়াজ রফতানি করবে, এমন খবরে দাম কিছুটা কমেও যায়। গত বছরেও ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল, তখন ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছিল পেঁয়াজ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদার প্রায় ৫৭ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে, প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এ কারণেই পেয়াঁজের ব্যাপারে ভারত কোনো সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে।

এছাড়া মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, চীন থেকেও বাংলাদেশে অল্প কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। তবে এই উৎপাদন থেকে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে মোট পেঁয়াজের উৎপাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ থেকে ১৯ লাখ টনে। অথচ দেশের বাকি চাহিদা পূরণ করতে প্রায় ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। প্রতিবেশী দেশ, সড়ক পথে দ্রুত আনা, কম দাম বিবেচনায় প্রধানত ভারত থেকেই বেশিরভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদার পুরোটা পূরণ করতে হলে দেশেই অন্তত ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন করতে হবে। তাহলে যেটুকু নষ্ট হবে, তা বাদ দিয়ে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে দেশের পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।

দেশের পেঁয়াজের চাহিদা দেশেই কীভাবে মেটানো সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে মসলা জাতীয় ফসলের গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলছেন, ‘দাম যদি স্থিতিশীল রাখা যায়, অন্তত উৎপাদন মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে রাখা যায়, সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা যায় আর শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন বীজের পর্যাপ্ত যোগান দেয়া যায়, তাহলে আগামী পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারব ।’

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও পেঁয়াজ উৎপাদনে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। তবে যেসব সমস্যা সমাধান করলেই বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে-

বীজের অভাব

বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের ভালো ও উন্নত বীজের অভাব রয়েছে। গত বছর এক কেজি পেঁয়াজের বীজের দাম আড়াই হাজার টাকা, অর্থাৎ এক মণ পেঁয়াজের দাম এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এই বছর দুই লাখ টাকা দিয়েও এক মণ পেঁয়াজের বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সামনের বছরের উৎপাদনে।

ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর মোট ১১০০ টন পেঁয়াজের বীজের দরকার হয়। সরকারিভাবে পাঁচ-ছয় টন, বেসরকারিভাবে ৫০-৬০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদিত হয়। বাকিটা কৃষকরা উৎপাদন করেন।’

সমন্বিত চাষাবাদ

ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন ‘ঘাটতি ১০ লাখ টন পূরণ করার জন্য আমাদের বাড়তি জমিরও দরকার হয় না। আমাদের যে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার জমিতে পেঁয়াজ চাষ হয়, সেখানেই ভালো জাত আর উৎপাদন কলাকৌশলে পরিবর্তন আনলে, কৃষকদের একটু প্রশিক্ষণ দিতে পারলেই চার-পাঁচ লাখ টন উৎপাদন বাড়ানো যায়। সেই সঙ্গে আমাদের অন্যান্য ফসলের সঙ্গে, যেমন আখের ক্ষেতে, ভুট্টার ভেতর, আদা-হলুদের সঙ্গে পেঁয়াজ চাষ করা যায়। গরমের সময় কচুমুখীর ক্ষেতে চাষ করা যায়।’

দামের ওঠানামা

ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, পেঁয়াজ চাষাবাদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো এর দামের ওঠানামা। কখনো কৃষক চাষাবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েন। আবার কখনো অতিরিক্ত দামের কারণে বীজ পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন।

গতবছর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কৃষক অক্টোবর মাসে তাদের পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে অনেক কৃষক এই বছর বীজ খুঁজে পাচ্ছেন না।

আবার ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে পেঁয়াজের মন ছিল ৪০০ টাকা, যেখানে একমণ উৎপাদন করতে তাদের খরচ হয়েছে সাড়ে ৬০০ টাকা। ফলে লোকসান হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক কৃষক আর পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হন না।

সংরক্ষণ ব্যবস্থা

বাংলাদেশে শুধুমাত্র পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কোনো কোল্ড স্টোরেজ নেই। কিন্তু সারা বছরের চাহিদা মেটানোর মতো পেঁয়াজ উৎপাদিত করতে হলে সেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বর্তমানে কৃষকরা নিজেদের বাড়িতে দেশীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। কিন্তু তাতে পেঁয়াজ নষ্ট হওয়ার হারটা বেশি হয়।

গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন

বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র বর্তমানে পেঁয়াজের ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। তার মধ্যে তিনটি জাত গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত। সেগুলোর ভেতর বারি-৫ এর ওপর গবেষণাকারীরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন।

মার্চ মাসে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে অথবা অগাস্ট মাসে রোপণ করে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এসব পেঁয়াজের ফসল পাওয়া যায়।

ড. রুম্মান আরা বলছেন, ‘এসব গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ করলে সেটা চাহিদা বড় একটি অংশ যোগান দিতে পারে। কারণ এসব ফসল যখন উঠবে, তখন পেঁয়াজের দামও বেশি থাকে। ফলে কৃষকও লাভবান হবেন। আবার সারা বছর ধরেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন, যোগান অব্যাহত থাকবে।’

চরের জমি অন্তর্ভুক্ত করা

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ চর এলাকা রয়েছে। সেসব জমি যদি পেঁয়াজ উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদার ১০ লক্ষ টনের পুরোটা উৎপাদন করা সম্ভব।

ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ‘তবে সেজন্য পেঁয়াজ উৎপাদনের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। তাহলেই কৃষকরা পেঁয়াজ চাষাবাদে আগ্রহী হবেন।’

ভয়েস টিভি/এসএফ

You may also like