Home ভিডিও সংবাদ ঐতিহ্যবাহী ফুকরা মদন মোহন একাডেমী

ঐতিহ্যবাহী ফুকরা মদন মোহন একাডেমী

by Amir Shohel

ফুকরা মদন মোহন একাডেমী। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্কুল। জেলা শহর থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক হয়ে কাশিয়ানীতে যেতে ২২ কিলোমিটার আর কাশিয়ানী উপজেলা থেকে জেলা শহরে যেতে ১৮ কিলোমিটার গেলেই, মহাসড়কের পূর্ব দিকে দেখা মিলবে স্কুলটির বিশাল গেট।

গেটের রাস্তা ধরে কয়েক কদম এগুলেই চোখে পড়বে একটি মসজিদ। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রার্থনার জন্য স্কুলের জায়গায় এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আর একটু সামনে গেলেই দেখা মিলবে স্কুলটির শতবর্ষী ভবন। যা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ১শ ১৮ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কাশিয়ানী থানার ঘৃতকান্দি গ্রামের গীরিশ চন্দ্র বসু। আর স্কুলের জন্য জমি দিয়েছিলেন ফুকরা গ্রামের তত্কালীন জমিদার অনাথ বন্ধু মুখোপ্যাধায়। জমিদার অনাথ বন্ধু ছিলেন গীরিশ চন্দ্রের গুরুদেব।

১৮০০ সালের শেষ দিকে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ফুকরা গ্রামে গিয়েছিলেন গীরিশ চন্দ্র। তখন ফুকরা গ্রামে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করার জন্য গীরিশ চন্দ্রকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন জমিদার অনাথ বন্ধু। এক পর্যায় গীরিশ চন্দ্র সম্মতি জানায়।

তখন গুরুদেব বলেন- আমার এলাকায় ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, তাই আমি জমি দিচ্ছি তুমি একটি স্কুল করে দাও। তখন সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যান গীরিশ চন্দ্র। এরপর জমিদার অনাথ বন্ধু বিদ্যালয়ের নামে ৫ একর ১৭ শতাংশ জমি দান করে।

১৯০১ সালের প্রথম দিকে গীরিশ চন্দ্র এই স্থানেই টিনের ঘর তোলার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯০২ সালের প্রথম দিকে সাতজন শিক্ষক ও শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিদ্যালয়ের পথ চলা শুরু হয়। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইন্দু ভূষণ রায়।

১৯০৫ সালে ২য় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান উপেন্দ্রনাথ ঘোষ। ১৯১৬-১৯৪০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় প্রধান শিক্ষক ছিলেন শশী ভূষণ ভট্টাচার্য। প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর ১৯৫০ সালে একাডেমিতে প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায় মোঃ রুস্তম আলী।

১৯৭০-২০০২ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ১৯ তম প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অময় কান্তি চৌধুরী। তিনি একমাত্র ৩২ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বাকী প্রধান শিক্ষকরা ১ থেকে সর্বোচ্চ ৬ বছর করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মদন মোহন একাডেমির বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. জইন উদ্দিন ২০০৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এখনও সুনামের সঙ্গে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন।

বিদ্যালয়টির নামকরণ নিয়ে তথ্য সমৃদ্ধ কোন ইতিহাস সংরক্ষণে নেই। তবে কেউ কেউ বলে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বিদের অবতার শ্রীকৃষ্ণের ১০৮টি নামের মধ্যে একটি হচ্ছে মদম মোহন। শ্রীকৃষ্ণের সেই নামানুসারেই স্কুলটির নামকরণ করা হয় ফুকরা মদন মোহন একাডেমি।

এছাড়াও জনশ্রুতি আছে প্রতিষ্ঠাতা গীরিশ চন্দ্র বসুর ছোট বোন অল্প বয়সে বিধবা হন। তৎকালীন সময়ে বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকায়, তিনি ২ বছর বয়সী ভাগ্নে বেনী মাধবসহ বোনকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। গীরিশ চন্দ্র বসু ভাগ্নেকে ভালোবেসে মদন মোহন বলে ডাকতেন।

ভাগ্নের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্মবোধ থেকেই গীরিশ চন্দ্র ভাগ্নে মদন মোহনের নামে স্কুলটির নামকরণ করেন ফুকরা মদন মোহন একাডেমি। মামার মৃত্যুর পর তার সকল ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতেন মদন মোহন।

১৯২০ সালে মদন মোহন অনুভব করলেন টিনের ঘরের স্থানে স্কুলে পাকা ভবন প্রয়োজন। তখন তিনি মামার স্মৃতিকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য সুদুর অষ্ট্রেলিয়া থেকে স্টিমারযোগে লোহার পাত, গজারি কাঠ এবং চুন সুরকি এনে ৭ কক্ষ বিশিষ্ট ২শ ফুট দীর্ঘ একটি অর্ধদ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ করেন।

১৯০২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যালয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। ১৯০২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে সুনামের সঙ্গে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

মদন মোহন একাডেমির ৫ একর ১৭ শতাংশ জমির মধ্যে ১৯৭২ সালে ৩৩ শতাংশ জমিতে ৯৯ নং ফুকরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের জায়গা না বাড়লেও বেড়েছে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা।

পুরাতন ভবনসহ মোট ৪টি পাকা ভবন রয়েছে বিদ্যালয়টিতে। রয়েছে দুটি টিন সেড ঘর ও সততা স্টোর। বিদ্যালয়টির পাশেই রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুর থেকে উপকৃত হয় শতাধিক পরিবার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন শত শত মানুষ গোসল করে থাকেন এখানে।

বিদ্যালটির শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় জ্ঞান বাড়ানোর জন্য রয়েছে একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। আর মেধা বিকাশের জন্য রয়েছে একটি পাঠাগার। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বিজ্ঞান ভবন ও একটি আধুনিক বিজ্ঞানাগার রয়েছে।

এছাড়াও রয়েছে একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ ও সুবিশাল খেলার মাঠ। এই মাঠে শিক্ষার্থীদের পাশাপশি গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও খেলাধুলা করে থাকে।

বর্তমানে স্কুলটিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন ১৪ জন এবং খণ্ডকালিন শিক্ষক ৩ জন। এছাড়াও একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন অফিস সহকারী, ১ জন মেয়ে ও ১ জন নৈশ প্রহরী রয়েছে।

একাডেমির বর্তমান শিক্ষার্থী ৮৮৬ জন। বিদ্যালয়টি ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে এসএসসিতে ৯৯ ভাগ পাসের গৌরব অর্জন করে। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে জেএসসি পরীক্ষায় ৮১ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করে উপজেলার মেধা তালিকায় রয়েছে।

একাডেমিটির দক্ষিণমুখী পাকা ভবনটি এখনও কালের সাক্ষী হিসেবে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। আধুনিক শিক্ষার নব চেতনায় বলীয়ান এই প্রতিষ্ঠান। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার সদা ব্রত নিয়ে কাজ করে চলেছেন শিক্ষকরা। ৮ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে বিশ্বায়নের স্রোতধারায় সমান তালে এগিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় একাডেমির সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ছিল গভীর মিতালী। এজন্য চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এই প্রতিষ্ঠানটির। বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী শুকলাল প্রামাণিক।

সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহু গুণীজন লেখা পড়া করেছেন। তাদের মধ্যে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কমডোর এস এম কামরুল হক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এস এম বদিয়ার রহমান, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কে এম দেলোয়ার হোসেন, ডাক্তার কালী রঞ্জন ভট্টাচার্য, ডাক্তার গাজী আমির আলী অন্যতম।

শিক্ষকদের সুনিপুণ কর্মদক্ষতা ও প্রচেষ্টা শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গী গঠনে প্রেরণা যুগিয়েছে সর্বক্ষণ। আর তারই ফল হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের আলোয় আলোকিত হয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়াচ্ছেন অনেকেই।

গিরীশ চন্দ্র বসুর লালিত স্বপ্ন এখনও ধ্বনিত হয় ফুকরার এই বিদ্যাপীঠে। আজও অবলীলাক্রমে শ্রদ্ধাবনতভাবে ফুকরাবাসী স্মরণ করে মহীয়ান পুরুষ গিরীশ চন্দ্র বসুকে। এখনও মধুমতির বহমান স্রোতধারার কলকল ধ্বনিতে উচ্চারিত হয় ফুকরা মদন মোহন একাডেমির জয়গান।

ভয়েসটিভি/টিআর/এএস

You may also like