Home ভিডিও সংবাদ ইতিহাস-ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা

ইতিহাস-ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা

by Amir Shohel
সাতক্ষীরা

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা জেলা। এ জেলার আদি নাম সাতঘরিয়া। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মচারী হিসেবে ১৭৭২ সালে নিলামে পরগনা কিনে গ্রাম স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী সাতঘর কুলীন ব্রাহ্মণ এনে এই পরগণায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং নাম হয় সাতঘরিয়া।

১৭৮১ সালে বর্তমান যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, খুলনার বৃহত্তর অংশ একই জেলা হিসেবে আসে। এক অনির্বচনীয় নান্দনিক অনুভবের প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা একসময় রাজা প্রতাপাদিত্যের যশোহর রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো। বারোভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী এ জেলার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায়।

বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। এ জনবসতি প্রাচীনকালে খ্যাত ছিল বুড়ন দ্বীপ নামে। এর পাশে চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ, জয়দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপখ্যাত ছোট ছোট ভূখণ্ডের অবস্থান পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাস ও মানচিত্রে। ঠিক কোন সময় থেকে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয় তার বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না।

সাতক্ষীরা জেলার জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্ভূক্ত। এখানে শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ও গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রচুর মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়। মৌসুমী বায়ুর কারণে জেলায় বৃষ্টিপাতের হার অপেক্ষাকৃত অধিক। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নানা ধর্মাবলম্বী, নানা পেশার, নানা ভাষার লোক বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরা নামের জনপদে তাদের বসত গেড়েছেন।

সঙ্গত কারণেই তাদের কিছু কীর্তির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে এখানে। সংরক্ষণের অভাব, ঐতিহাসিক নিদর্শন ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার, লবণাক্ত আবহাওয়া, ধ্বংস ইত্যাদি কারণে বহু প্রাচীন নিদর্শন আজ বিস্মৃতির অতলে, তবু এখনো যে নিদর্শনসমূহ টিকে আছে তা দেখে ও তার ইতিহাস ঘেটে নির্দ্বিধায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম নিদর্শনসমূহের পাশাপাশি অতি সহজেই এ প্রাচীন কীর্তিগুলো স্থান লাভের যোগ্য।

সাতক্ষীরায় রয়েছে কয়েকটি ফিস প্রসেসিং প্লান্ট, কোল্ড স্টোরেজ, আইস প্লান্ট, রাইস মিল, অটো রাইস মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, বেকারী, ইট ভাটা, বাঁশ ও বেতের দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, তাঁত, লবণ, গুড়, পাটজাত দ্রব্য ও মাছ। এসব বর্তমানে সাতক্ষীরা শিল্প বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।

মূলত মাছ চাষই সাতক্ষীরার অর্থনীতির মূল ভিত। বিশেষ করে চিংড়ি চাষ। সাতক্ষীরার দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মৎস চাষের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে ৫৫ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। এখানে বছরে ২২ হাজার মেট্রিক টনের মতো চিংড়ি উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ভোমরা স্থল বন্দরের অবস্থানও সাতক্ষীরায়। ১৯৯০ সালে শুল্ক স্টেশন হওয়ার পর ১৯৯৫ সাল থেকে এ বন্দরটি ভোমরা স্থল বন্দর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাও সাতক্ষীরার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

বিস্তৃর্ণ উপকূলীয় এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার মোজাফফর গার্ডেন এণ্ড রিসোর্টটি মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি নামে বহুল পরিচিত। সাতক্ষীরা জেলা সদরে ১২০ বিঘা জায়গাজুড়ে কে. এম খায়রুল মোজাফফর মন্টু এটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৮৯ সালে। সবুজে পরিপূর্ণ ও খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজেই এখানে আগত অতিথিদের নজর কাড়ে।

আধুনিক জীনযাপনের সমস্ত নাগরিক সুবিধা রয়েছে এখানে। লেকে রয়েছে প্যাডেল বোট ও মাছ ধরার ব্যবস্থা। এছাড়া আছে মিটিং ও কনফারেন্স রুম, মাছের অ্যাকুরিয়াম, থ্রিডি থিয়েটার ও চিড়িয়াখানা, চিল্ড্রেন পার্ক, খেলার মাঠ ও আকর্ষণীয় ভাস্কর্য। পিকনিকের জন্য রয়েছে ১০৫টি পিকনিক স্পট। এই গার্ডেনটি সাতক্ষীরা জেলাকে নতুনভাবে পরিচিত করেছে। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মানুষরা এখানে আসেন ঘুরতে ও দেখতে।

দেবহাটা উপজেলায় রহস্যময় ঘেরা বনবিবির বটগাছ। এটি প্রায় তিনশ বছরের বেশী পুরনো বলে ধারণা করা হয়। আট বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছে বটগাছটি। জনশ্রুতি রয়েছে তিনশ বছর আগে জমিদার ফণিভূষন মন্ডল গাছটিকে দেবী জ্ঞান করে নাম রাখেন বনবিবির বটগাছ। তখন থেকেই পূজা শুরু।

এই বটগাছটির মূল কোথায় সেটি আজও জানা সম্ভব হয়নি। প্রতিনিয়তই দূরদূরান্ত থেকে বটগাছটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা। জনশ্রতি রয়েছে, বটগাছটির ডাল যিনি কাটবেন তিনিই বিপদে পড়বেন। সে কারণে গাছটির কোন ডালপালাও কেউ কখনো কাটেন না।

সাতক্ষীরার কালিগজ্ঞ উপজেলার নলতা গ্রামে ১৮৭৩ সালে ডিসেম্বরে জন্মগ্রহন করেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী খান বাহাদুর আসহানউল্লাহ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও আউলিয়া হিসেবেও তিনি সমাদৃত।

১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র মৃত্যুর পর তাকে নলতায় সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে তার সমাধিস্থলকে কেন্দ্র করে বর্তমানে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ সমাধি কমপ্লেক্স বা নলতা শরীফ গড়ে ওঠে।

৪০ বিঘা জমির উপর মসজিদ, মাজার, লাইব্রেরী, অফিস, অতিথিশালা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পুকুর, ফুলের বাগান ও দৃষ্টিনন্দন সমাধি সৌধ। আর এই সমাধি সৌধে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজসহ মোট ৯টি আকর্ষণীয় গম্বুজ। স্থানটি পবিত্র স্থান হিসেবে সকল শ্রেণি পেশার মানুষদের মাঝে সাতক্ষীরাকে পরিচিত করে দেয়।

সাতক্ষীরার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয়স্থানগুলোর মধ্যে দেবহাটার জমিদার বাড়িটি অন্যতম। দেবহাটা ইউনিয়নের টাউনশ্রীপুর গ্রামে দেবহাটার জমিদারবাড়িটি অবস্থিত। দেবহাটাকে এই জমিদার বাড়িটি নতুনভাবে পরিচিতি এনে দেয়। দর্শনার্থীরাও ঘুরে দেখেন এই বাড়িটি। জানবার চেষ্টা করেন তৎকালীন জমিদারদের সম্পর্কে।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া জামে মসজিদ। খান বাহাদুর মৌলভী কাজী সালামাতুল্লাহ খান, তেতুলিয়ার তৎকালীন জমিদার কাজী পরিবারের বংশধর এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি খান বাহাদুর সালামতুল্লাহ মসজিদ, তেতুলিয়া শাহী মসজিদ, মিয়া মসজিদ নামে সর্বাধিক পরিচিত।

ছয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি মুঘল স্থাপত্য নিদর্শন অনুকরণ করে ১৮৫৮-৫৯ সালে নির্মাণ করা হয়। দেখতে অনেকটা টিপু সুলতানের বংশধরদের আমলে তৈরীকৃত বিভিন্ন স্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জনশ্রুতি রয়েছে এই মসজিদটির নকশা ও নির্মাণকারীর হাত কেঁটে নেয়া হয়েছিল মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর। এই মসজিদটি দেখতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন এখানে। এ মসজিদটি তালা উপজেলাকে নতুনভাবে পরিচিত করেছে।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আগোলঝাড়া মাঠ বা জিনের মাটির টিবি নামে এলাকায় জনশ্রুতি থাকা স্থানটি মূলত প্রত্নতাত্নিক নিদর্শন। ২০১৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মাটি খুড়ে সেখানে প্রাচীন আদি মধ্যযুগীয়কালের নিদর্শন খুঁজে পায়। বর্তমানে সেটি দর্শনীয়স্থান হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।

পর্যটনকে ঘিরে এ জেলার রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের একটা বড় অংশ রয়েছে এ জেলায়। সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্রগুলো আকৃষ্ট করে ভ্রমণ পিপাষুদের।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like