Home জাতীয় কাগজ ও কংক্রিটে একজন সুলতান

কাগজ ও কংক্রিটে একজন সুলতান

by Amir Shohel

“যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে, তার গ্রামের ছবি আঁকে,
সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে,
গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনোদিন অপরাধ করতে পারে না,
সে কোনোদিন কাউকে ব্যথা দিতে পারে না।”
এই উক্তিটি এসএম সুলতানের। যার রংতুলিতে আজও জীবন্ত বাঙালি, বাংলাদেশ।

পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। বাবা আদর করে ডাকতেন লাল মিয়া নামে। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে। তার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে খরস্রোতা চিত্রা নদী। তাইতো তাকে বলা হয় ‘চিত্রা পাড়ের সুলতান’।

রাজমিস্ত্রী বাবা চাইতেন ছেলেও রাজমিস্ত্রী হবেন। কিন্তু কংক্রিট নয় ক্যানভাস হিসেবে সুলতান বেছে নিয়েছেলেন কাগজ। দরিদ্র বাবা সামর্থ্য না থাকা স্বত্বেও স্কুলে ভর্তি করেছিলেন সন্তানকে। কিন্তু স্কুলের গদবাধা নিয়ম তো আর সবার জন্য না!

এসএম সুলতানও সহ্য করতে পারেননি প্রতিষ্ঠান। চিত্রা পাড়ে বসে স্কেচ করেই তিনি কাটাতে থাকলেন সময়। নদীর ঢেউ, গাছের সবুজ এক যাদুকরের মত বন্দি করতে থাকলেন কাগজের মধ্যে।

শিল্পের শুদ্ধতার জন্য দরকার বিশুদ্ধ বিরহ, এমনও বলে গেছেন কেউ কেউ। সুলতানের শৈশবে প্রেম হয় তার শিক্ষক রঙ্গলালের মেয়ে আরোরার সঙ্গে। কিন্তু রঙ্গলাল এই সম্পর্ক মানেননি।

আরোরার বিয়ে দিয়ে দেন অন্য পাত্রের সঙ্গে। সুলতান বিরহ ব্যথায় বুদ হয়ে চলে আসেন নড়াইল শহরে। সঙ্গে আনেন অরোরার হাতে তৈরি একটি নকশী কাঁথা। যে কাঁথাটি আমৃত্যু সঙ্গে ছিল তার।

কলকাতায় গিয়ে আর্ট শিখতে চাইলেও সেই আর্থিক সঙ্গতি ছিলো না সুলতানের। সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেন এবং সেখানে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা তার ছিলো না। সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য তাকে সহযোগিতা করেন শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। এ সময় শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তার লাল মিয়া নাম পাল্টে এস এম সুলতান রাখেন।

আর্ট স্কুলে ভালো করলেও ফাইনাল পরীক্ষার আগে আর্ট স্কুল ছেড়ে তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কাশ্মীরে আদিবাসীদের সাথে থাকতে শুরু করেন। আঁকতে শুরু করেন তাদের জীবনযাত্রা। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি তার কাজের প্রতিও ছিলেন বেখেয়ালী। জীবনে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। যে জায়গায় কাজ করেছেন সেখানেই তা ফেলে এসেছেন। এভাবে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে সুলতানের অনেক সৃষ্টি।

দেশে-বিদেশে অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন সুলতান। ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার সুলতানকে ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট সম্মাননা প্রদান করে। গুণী এ শিল্পী পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাকে ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স’ ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার ‘গ্যালারি টনে’ ছিল সুলতানের শেষ চিত্র প্রদর্শনী।

দেশ-বিদেশের খ্যাতি তাকে গ্রাম থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তার চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল আলাদা। তিনি শহর আঁকতেন না। তথাকথিত আধুনিক চিত্রকলার অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ধরণ তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি সেভাবেই ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। তিনি আঁকতেন মানুষ, কৃষক, নারী, শিশু, গাছপালা, গ্রামের দৃশ্য ।

১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর সুলতান এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রেখে যান এক ইতিহাস, এক আদর্শ। যে আদর্শ যুগ যুগ ধরে অনাগত শিল্পীদের শেখাবে কীভাবে নিঃস্বার্থভাবে শিল্পের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। কীভাবে জীবনকে আরও কাছ থেকে দেখতে হয়।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like