Home বিশ্ব কীর্তিমান আবিস্কারক এ পি জে আব্দুল কালাম

কীর্তিমান আবিস্কারক এ পি জে আব্দুল কালাম

by Amir Shohel

একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এ পি জে আব্দুল কালাম। যার পুরো নাম আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম। ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি ও বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক এ পি জে আব্দুল কালাম সমগ্র ভারতবাসীর কাছে অনেক বড় একটি গর্বের বিষয়।

তার অনন্য কীর্তি ও দেশাত্ববোধ প্রতিটি মানুষের কাছে আজো এক মহান অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। ৮৪ বছরের জীবন কালে তার সৃজনশীল চিন্তা, কীর্তমান আবিস্কার ও নিস্বার্থভাবে ভারতবাসীর জন্য করে যাওয়া উন্নয়ন পুরোবিশ্ব আজীবন স্মরণ রাখবে।

আব্দুল কালাম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম শহরে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল জয়নুল আবেদিন। রামেশ্বরমে একজন সামান্য নৌকাচালক ছিলেন তিনি। তার কাজছিল প্রতিদিন হিন্দু তীর্থ যাত্রীদের রামেশ্বরম ও তার পাশের ধনুশকডিতে পারাপার করানো।

বিখ্যাত এই মানুষটির মায়ের নাম ছিল অশ্বিআম্মা। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। আব্দুল কালাম দরিদ্র পরিবারে সন্তান হওয়ায়, ছোট বেলায় নিজের লেখা পড়ার খরচ চালাতে বিক্রি করতেন খবরের কাগজ।

অনেক অভাব অনটনের পরেও এই গুণী মানুষটি কখনোই তার বাবা মাকে এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ করেননি। স্কুল জীবনে সাধারণ মানের ছাত্র থাকলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও কঠোর পরিশ্রমী। শিক্ষাগ্রহণের তীব্র বাসনা ছিল তার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি পড়াশোনা করতেন ও অঙ্ক কষতেন।

এ পি জে আব্দুল কালাম রামনাথপুরম স্কোয়ার্টজ ম্যাট্রিকুলেশন স্কুল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফ’স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে সেই কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে। পাঠক্রমের শেষের দিকে তিনি পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে তিনি মাদ্রাজে চলে আসেন। মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে তিনি বিমানপ্রযুক্তিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। স্কুল জীবন থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ভারতীয় বায়ুসেনার একজন বিমান পাইলট হওয়ার। আব্দুল কালাম অল্পের জন্য পাইলট হওয়ার সুযোগ হারান। এক পরীক্ষায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর আট জন কর্মীর দরকার ছিল কিন্তু তিনি পরীক্ষায় নবম হয়েছিলেন।

১৯৬০ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার এরোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এস্টব্লিশমেন্টে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি একটি ছোট হোভারক্রাফটের নকশা তৈরি করে তার কর্মজীবন শুরু করেন।

কালাম ভারতীয় জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কমিটিতে প্রখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. বিক্রম সারাভাইয়ের অধীনে কাজ করতেন। এরপর তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষনা প্রতিষ্ঠান আই.এস.আরো’তে যোগদান করেন। আর সেখানে অনেক বছর কাজ করে বিভিন্ন মহাকাশ সম্বন্ধে পরিকল্পনা সফলতা সঙ্গে পরিচলনা করেন।

এই বিজ্ঞানী তার নিজের তৈরি ভারতের সর্বপ্রথম উপগ্রহ রেহিনি অর্থাৎ এস.এল.ভি.থ্রি এর সফল উৎক্ষেপন করে। সেই সঙ্গে সেটাকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করতে সফল হন। এছাড়াও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আই.এস.আর.ও এর হয়ে এমন অনেক মহাকাশ বিষয়ক কাজ করেছিলেন। যার দৌলতে সেই সময় ভারত আর্ন্তজাতিক স্পেস ক্লাবের সদস্য হতে পেরেছিলেন।

তখনকার সময় তিনি ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী রাজা বামান্যোর সাথে মিলে ভারতের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হন। ১৯৮২ সালে আব্দুল কালাম ভারতীয় প্রতিরাক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। সে বছর আন্না বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধিতে সম্মানিত করে।

স্বদেশি মিশাইলে উন্নতির জন্য তার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় যেখানে তিনি সভাপতি ছিলেন। ভারতের সর্বচ্চপদে নিযুক্ত হওয়ার আগে ভারত রত্ন সম্মানের অধিকারি হওয়া ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্দুল কালাম।

১৯৯৮ সালে তার নেতৃত্বেই ভারত দ্বিতীয়বারের জন্য পরমাণু বোমার সফল ভাবে পরিক্ষা করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে তার জন্য ভারত পরমাণু হাতিয়ার নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০২ সালে ভারতের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও জনতার প্রতি সম্মানকে গুরুত্ব দিয়ে তৎকালীন সরকার তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ঘোষণা করেন।

রাজনীতিতে থাকার মাধ্যমে তিনি সর্বদা দেশের উন্নতির কথা ভাবতেন। তিনি মনে করতেন যুব সমাজের উন্নতি পারে এই দেশেকে অনেক এগিয়ে নিতে যেতে তিনি এটাও চেয়েছিলেন যে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ভারত একটি বড় শক্তি হিসাবে পরিচিত পাক বিশ্বের বুকে ।

তিনি বলেছিলেন- ভারতকে ৬০০ বছর ধরে অন্য শক্তিরাই শাসন করছে। ভারতের বিকাশের জন্য শান্তির পরিস্থিতি থাকা অবশ্যক আর শান্তি শক্তি দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয় এই কারণে ক্ষেপণাস্ত্রকে বিকশিত করা হয়েছে যাতে দেশ শান্তিপূর্ণ হয় ।

২০০৭ সালের আব্দুল কালামের রাষ্ট্রপতি হওয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তারপর তিনি ভারতের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর হিসাবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ইনস্টিটিউড অফ সিলং আহমেদাবাদ এবং ইন্দোরের মতো অনেক ভারতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও তিনি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে ছিলেন। এছাড়া আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ার স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক হিসেবেও অনেক বছর কাজ করেছেন এই গুণীজন।

২০১৫ সালে ২৭ জুলাই মেঘালয়ের শিলং শহরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানে বসবাসযোগ্য পৃথিবী বিষয়ে বক্তব্য রাখার সময় ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের দিকে আব্দুল কালাম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন তাকে বেথানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু ঘটে।

মৃত্যুর পরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে শিলং থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানে নতুন দিল্লির পালাম বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ভারতের তৎকালিন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তিন বাহিনীর প্রধান তার মরদেহে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এরপর জাতীয় পতাকায় ঢেকে তার মরদেহ ১০ রাজাজি মার্গে দিল্লির বাসস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবসহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিরা শেষ শ্রদ্ধা জানান।

ভারত সরকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের মৃত্যুতে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা করে।

এই গুণীজনের চির বিদায়ে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা। তারই অংশ হিসেবে ভুটান সরকার দেশের পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও এক হাজার বাতি প্রজ্জ্বলনের নির্দেশ দেয়।

ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সুসিলো বমবাং ইয়ুধোয়োনো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং আব্দুল কালামের প্রতি সম্মান জানান ও তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like