Home জাতীয় কমছে না জ্বালানি তেলের দাম, সারাদেশে নাজুক অবস্থা

কমছে না জ্বালানি তেলের দাম, সারাদেশে নাজুক অবস্থা

by Mesbah Mukul

জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধিতে সারাদেশে একরকম নৈরাজ্য অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহন মালিকরা বেশি ভাড়ার দাবিতে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রেখেছে। ফলে সাধারণ মানুষ বড় ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে তেলের দাম কমাতে প্রতিবাদ করছেন। তেলের দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। উল্টো তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।

তেলে দামবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমের কাছে বলেন, তেলের দাম বাড়ানো হয়নি, সমন্বয় করা হয়েছে। ভারতসহ বিশ্বে দামবৃদ্ধি এবং পাচার ঠেকাতেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সাথে মিলিয়ে সমন্বয় করেছি। বিশ্ববাজারে দাম কমলে আমরাও দাম কমিয়ে দেব। দাম সমন্বয় না করলে জ্বালানি তেল পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এদিকে দাম না কমিয়ে উল্টো আরও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। গতকাল সুনামগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে, এটিই শেষ নয়। আমরা যে জায়গায় চিন্তা করছি; এটিই শেষ নয়, খাদ আরও গভীর। আমরা পেট্রল, ডিজেল তৈরি করি না। যারা মূল মহাজন, তারা যখন দাম বাড়ায়, তখন আমাদের কিছু করার থাকে না।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রতিবেশী দেশে জ্বালানি পাচার রোধকল্পে সরকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, লন্ডনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার সব সময়ই জনস্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।

এদিকে সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা লিটার করে সরকার, যার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় পরের দিন ৪ নভেম্বর। এবার সরকারের দাম বাড়ানোর যুক্তি ছিল- বিশ্ববাজারে জ্বালানির তেলের দাম বেশি হওয়ায় বিপিসিকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোরালো যুক্তি ছিল পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে ডিজেলের দাম বেশি হওয়ার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য দাম বাড়াতে হয়েছে।

এদিকে ১৯৯০ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর ৩ তারিখ পর্যন্ত ডিজেলের দামবৃদ্ধি বা কমার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় অন্তত ২৩ বার দেশে ডিজেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের তুলনায় অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ ডিজেলের দাম বেশি ছিল। সেই সময় বাংলাদেশে দাম কমানো হয়নি। ভারতে ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সব সময় বাড়ানো বা কমানো হলেও এ দেশে কমানোর নজির খুব কম।

দুয়েকবারের ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া ১৯৯০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। ১৯৯০ সালের ২৭ ডিসেম্বর দেশে ডিজেলের দাম ছিল ১৭ টাকা লিটার, ২০০৩ সালের ৫ জানুয়ারি হয় ২০ টাকা, ২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর হয় ২৩ টাকা লিটার, ২০০৫ সালের ২৫ মে হয় ২৬ টাকা লিটার, ২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারি হয় ৩০ টাকা, একই বছরের ৯ জুন হয় ৩৩ টাকা লিটার, ২০০৭ সালের ২ এপ্রিল হয় ৪০ টাকা লিটার, ২০০৮ সালের ১ জুলাই হয় ৫৫ টাকা।

১৯৯০ থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রথমবারের মতো ডিজেলের দাম ৭ টাকা কমিয়ে ৪৮ টাকা করে সরকার। পরে ২০১০ সালের ১১ মে সেটি আরও কমিয়ে ৪৪ টাকা করে। কিন্তু ২০১১ সালের ৬ মে ডিজেলের দাম আবার বেড়ে ৪৬ টাকা লিটার করা হয়। ২০১১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর করা হয় ৫১ টাকা। একই বছরের ১১ নভেম্বর করা হয় ৫৬ টাকা, ৩০ ডিসেম্বর করা হয় ৬১ টাকা, ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি আরও বাড়িয়ে করা হয় ৬৮ টাকা। সর্বশেষ সেটি ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ৬৫ টাকা করার পর চলতি বছরের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল একই দামে। এই সময় বিপিসি ডিজেলে লাভ করে আসছিল। কিন্তু কোভিডপরবর্তী সময়ে চলতি জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকার অজুহাতে বিপিসি দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এক লাফে ১৫ টাকা।

এদিকে দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় জ্বালানি বিভাগ বলছে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। এতে ডিজেল বিক্রিতে লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। এমনটি চলতে থাকলে বিপিসির উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধার মুখে পড়বে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সমন্বয় করেছে সরকার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও তেলের দাম কমানো হবে বলে জ¦ালানি বিভাগ এক ব্যাখ্যায় জানিয়েছে। গত শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে। ৩ নভেম্বর রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। ৬৫ থেকে বেড়ে হয় ৮০ টাকা। কার্যকর হয় ৪ নভেম্বর থেকে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিনের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা নির্ধারণ করে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে সেই মূল্য লিটারপ্রতি ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা হয়। গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ডিজেল বা কেরোসিনের দাম অপরিবর্তিত ছিল এবং ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় ডিজেলে বিপিসি লোকসানের সম্মুখীন হয়।

চলতি বছরের জুনে ডিজেলে লিটারপ্রতি ২ টাকা ৯৭ পয়সা, জুলাইয়ে ৩ টাকা ৭০ পয়সা, আগস্টে ১ টাকা ৫৮ পয়সা, সেপ্টেম্বরে ৫ টাকা ৬২ পয়সা এবং অক্টোবরে ১৩ টাকা ০১ পয়সা করে বিপিসির লোকসান হয়। সে হিসাবে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলে বিপিসির মোট লোকসান প্রায় ১ হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা সরকারি ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করতে হবে। তা ছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রায় ৩৩ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে বিপিসি। এ অবস্থায় বিপিসি লোকসানে গেলে জ্বালানি নিরাপত্তায় হুমকি দেখা দেবে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডিজেলের দাম এখনো কম। ৩ নভেম্বর কলকাতায় ডিজেলের মূল্য ছিল ১০১.৫৩ রুপি বা ১২৪.৩৭ টাকা।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বা প্রতিবেশী দেশের তেলের দামে অজুহাত বিপিসি দিলেও যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকে, তখন এখানে দাম কমানো হয় না। ভারতে জ্বালানি তেলের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ওঠানামা করে। কিন্তু আমাদের এখানে একবার বাড়লে সেটি আর কমে না। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত অর্থবছরেও বিপিসি চার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালের পর অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। অথচ গত তিন-চার মাস কিছুটা লোকসান মেনে না নিয়ে এক লাফে ডিজেলে ১৫ টাকা প্রতি লিটারে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা অযৌক্তিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল ও কেরোসিন সবচেয়ে বেশি নিম্নআয়ের মানুষের, কৃষকের কাজে ব্যবহার করা হয়। অথচ এখানে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার বিরাট প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, বিপিসির প্রতিলিটার ডিজেলে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ ২০ টাকার ওপরে আদায় করছে। এখানে শুল্ক কমিয়েও ডিজেলের দাম বা লোকসান সমন্বয় করতে পারত। কিন্তু সেটি না করে জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়েছে।

ভারতে পাচারের অভিযোগ : বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ সীমান্তবর্তী জেলার জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে তেল পাচার প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই চিঠির সূত্রে জানা যায়, ভারতে মূলত পণ্যবাহী ট্রাকের মাধ্যমে তেল পাচার হয়ে থাকে। প্রতিদিন ২৬টি স্থলবন্দর দিয়ে শত শত পণ্যবাহী বড় বড় ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেসব ট্রাক ঢোকার সময় সামান্য তেল নিয়ে ঢোকে। যাওয়ার সময় ট্রাকের ট্যাংকি পুরোপুরি ভরে নিয়ে চলে যায়। এসব ট্রাকে ৩০০ লিটারের ওপরে ডিজেল ধারণ করার সক্ষমতা রয়েছে।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের বিভিন্ন ডিপো থেকে আমাদের সময়ের কাছে অভিযোগ এসেছে জ্বালানি তেলের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত পেট্রলপাম্প মালিক, ট্যাংকলরির মালিকরা আগে থেকেই জানতেন ডিজেলের দাম বাড়বে। ফলে ৩ নভেম্বরের আগে থেকেই তারা অতিমাত্রায় ডিজেল সংগ্রহ করে নিজস্ব সংরক্ষণাগারে রেখে দেন। গত সপ্তাহে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত ডিজেল বিক্রি হয়েছে তেল বিপণন কোম্পানির ডিপোগুলো থেকে। গোদনাইল মেঘনা ডিপো এলাকা থেকে একাধিক তেল ব্যবসায়ী আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন গোদনাইল মেঘনা ডিপো এলাকার সাবেক এক কাউন্সিলর প্রায় ৩ লাখ লিটার ডিজেল আগে থেকে সংগ্রহ করে গাড়ি ও তার নিজস্ব সংরক্ষণাগারে জমা করে রেখেছেন। ডিজেলের দামবৃদ্ধির ঘোষণার পর দিন সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছেন।

ডিপোর এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, গত এক সপ্তাহ যাবৎ যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে তেলের দামবৃদ্ধির সংবাদ আসছিল, তখন থেকেই তেল ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে ওঠেন।

ভয়েসটিভি/এমএম

You may also like