Home জাতীয় পায়রা সেতু কেড়ে নিল হাজারো মানুষের জীবিকা

পায়রা সেতু কেড়ে নিল হাজারো মানুষের জীবিকা

by Mesbah Mukul

দীর্ঘ চার দশকের প্রতীক্ষা শেষে নবনির্মিত পায়রা সেতু পেল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ফেরি দিয়ে লেবুখালী নদী পার হওয়ার দিন ফুরালো। যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়ায় প্রয়োজন ফুরিয়েছে ফেরি ও ফেরিঘাটের। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে ফেরিকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করা হাজারো ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষ।

বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার দ্বার উম্মুক্ত রাখতে গত ২৪ অক্টোবর সেতু উদ্বোধন করা হয় পায়রা সেতু। ফেরিঘাটের দুই পাড়ের সহস্রাধিক ফেরিওয়ালা ও টং দোকানের ব্যবসায়ীরা এখন অনেকটা নিরুপায় জীবন যাপন করছেন।

গত রোববার পায়রা সেতুর নিচে অবস্থিত সদ্য বিলুপ্ত লেবুখালি ফেরিঘাটের একাধিক টং দোকানের ব্যবসায়ী ও হকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়- ফেরিঘাটের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে এখন তাদের চোখে-মুখে ভেসে ওঠেছে হতাশার ছাপ। এখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান তারা।

পায়রা সেতু উদ্বোধনের ফলে যুগের পর যুগ কর্মব্যস্ত থাকা লেবুখালী ফেরিঘাটের বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালির দুমকি উপজেলার দুই প্রান্ত এখন সুনশান নিরবতা। যেখানে একসময় প্রতিদিন রাত-দিন ২৪ ঘন্টা ছিলো হাজার হাজার মানুষের পদচারনা। এই ফেরিঘাট দু’পাড়ে প্রায় সহস্রাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকারদের কর্মব্যস্ত ছিল মুখর পরিবেশ। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ছিলো হাজার হাজার মানুষের পদচারণা। সেখানে এমন নীরবতা যেন মেনে নেয়ার মত না।

গত ২৪ অক্টোবর বেলা সোয়া ১১টায় পটুয়াখালি প্রান্ত থেকে শেষ ফেরি যাত্রার মধ্য দিয়ে ৪০ বছরের ফেরি পারাপারের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ।

দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনে ফেরি ভোগান্তি নিরসনে মনের আনন্দে যখন উদ্বেলিত ঠিক সে মুহূর্তে বেকার হয়েছেন এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে ১৫-২০ জন সেতুর দুই প্রান্তে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করলেও অনেকেই অর্থসংকটে তা পারছেন না। ফলে তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। অর্থ সংকটে ফের ব্যবসা শুরু করতে না পারায় শঙ্কার পাশাপাশি প্রত্যেকের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

ফেরিঘাটের দুই পাড়ের ব্যবসায়ীরা জানান, বরিশাল প্রান্তে ৩৭৬ এবং পটুয়াখালি প্রান্তে ৫৩৯টি খাবার হোটেল, মুদি দোকান, চায়ের দোকান, ফলের দোকান, পেট্রোল-ডিজেলের দোকান ছিলো। এছাড়াও দুই পাড়ে দেড়শ থেকে দুইশ হকার ছিলো। যারা বাদাম, চানাচুর, চিড়াভাজা, ঝালমুড়ি, সিদ্ধ ডিম, ফল এবং আমড়া ও পেয়ারাসহ হরেক রকমের খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করতেন।

সড়ক ও জনপথের লেবুখালি ফেরিঘাটের চা বিক্রেতা মো. নুরুজ্জামান ফরাজী জানান, তার বাবা এ ফেরিঘাটে চা বিক্রি করতেন। ফেরি বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত ৩৫ বছর ধরে তিনিও ওই ঘাটে চা-পান বিক্রি করেছেন। সেতু চালু হওয়ায় এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণের শংকা প্রকাশ করেছেন তিনি। নুরুজ্জামানের মত একই অবস্থা আচার বিক্রেতা মিলনের।

বিগত ১২ বছর ধরে ওই ঘাটে আচার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন জানিয়ে মিলন জানান, সেতুর উদ্বোধন হওয়ায় আনন্দিত হলেও আজ তিনি বেকার। তাই সরকারি উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

শাহজাহান নামে চিড়া বিক্রেতা বলেন, সেতু চালুর মধ্য দিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি পুরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা। কিন্তু বেকার জীবনে কী করব বুঝতেছিনা। এখন সরকার যদি আমাদের জন্য কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করে তাহলে ভালো, নইলে ঢাকায় গিয়ে কিছু একটা করতে হবে। নাহলে তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

চিড়া বিক্রেতা আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ২০ বছর যাবত হাশেমের চিড়া ভাজা ফেরিতে বিক্রি করেছি। প্রতিদিন ২ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারলে মালিক ৫০০ টাকা দিত। তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিলো সংসার। সেতু চালুর পরও এখানে আছি; চেষ্টা করছি সেতুর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত গাড়িতে চিড়া বিক্রির ব্যবস্তা করতে পারি কিনা।

ফেরিঘাটের ফল বিক্রেতা মো. আসলাম গাজী জানান, পিতার রেখে যাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে আজ নিজের বয়সও শেষ প্রান্তে। এখানে ফল বিক্রি করেই চার ভাই-বোনের পড়াশুনা ও বিয়ে দিয়েছি। পরে নিজের তিন ছেলে-মেয়েকে পড়াশুনা এবং দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।

তিনি আরও জানান, একমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়ে চলছিলো পাঁচ সদস্যের সংসার। বর্তমানে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার।

একই কথা বলেন, ট্রলারচালক আব্দুর রহিম, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক খোরশেদসহ ফেরিতে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকরা।

দুমকি উপজেলার লেবুখালি ঘাটের শ্রমিক নেতা আব্দুর রশীদ বলেন, ফেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত দু’পাড়ের হাজারেরও বেশি মানুষের জন্য ফেরিঘাটে একটি পার্ক, একটি বাজার ও লঞ্চ টার্মিনাল স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখানে একটি ইকো পার্ক করার সুন্দর জায়গা রয়েছে। আগেও এখানে লঞ্চ ঘাট দিতো, সেটা পুনরায় চালু করা হলে সবাই আবার ব্যবসা শুরু করতে পারবো।

বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আশ্রাফুজ্জামান খোকন জানান, লেবুখালি ফেরির বরিশাল প্রান্তে প্রায় চারশ’ ছোট আকারের দোকান ছিলো। সেতু চালুর পর ৮ থেকে ১০ জন ব্যবসায়ি সেতুর ঢালে দোকান তুলেছেন। বাকীরা এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে এবং বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিচ্ছে দোকান ঘর তোলার জন্য।

দুমকি উপজেলার লেবুখালি ইউপি চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ দুলাল, ফেরিঘাটের প্রায় পাঁচ শতাধীক হোটেল, চা ও ফলের দোকানের মধ্যে ১০-১২ জন টোলপ্লাজায় দোকান তুলেছে। বাকীরা জমির ব্যবস্থা করতে না পারায় প্রতিদিন তার কাছে গিয়ে ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য বলছেন বলে চেয়ারম্যান দুলাল জানান।

বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়ন করতে গেলে কমবেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। পায়রা সেতু নির্মাণেও স্থানীয় ব্যবসায়ী-হকাররা সাময়িক সময়ের জন্য কর্মহীন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন জানালে ক্ষতিগ্রস্থদের আত্মকর্মসংস্থানে সরকারি সহায়তার জন্য সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার।

আরও পড়ুন : একটু পরেই খুলছে পায়রার দ্বার

ভয়েসটিভি/এমএম

You may also like