Home বিশ্ব পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ সুইজারল্যান্ড

পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ সুইজারল্যান্ড

by Amir Shohel

পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ বলা হয় যে দেশটিকে তার নাম সুইজারল্যান্ড। দেশটি বিশ্বজুড়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে অন্যতম কাঙ্খিত গন্তব্য। তবে শুধু বেড়ানোর জন্যই নয়, সব বিচারেই দেশ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেয়েছে ইউরোপের ছোট্ট এই দেশটি।

আয়তনে ছোট হলেও দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ। ইউরোপের পাহাড়ি দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সুইজারল্যান্ড। এর আয়তনের ৭০ শতাংশ ঘিরে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বতের নাম মন্টি রোজা।

আল্পস পর্বতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী ও ছবির মতো সাজানো গ্রাম সুইজারল্যান্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তুষার মুকুট পরিহিত আল্পসের চূড়া, ঝিলমিল করা নীল হ্রদ, এমারেল্ড ভ্যালী, হিমবাহ, রুপকথার গল্পের পল্লী আরও কতো কি! চলুন জেনে নিই সুন্দর এই দেশটির দর্শনীয় স্থানগুলোর কথা।

পশ্চিম ইউরোপের ছোট সুইজারল্যান্ড দেশটি সরকারিভাবে সুইস কনফেডারেশন নামে পরিচিত। এর উত্তরে জার্মানি, পূর্বে অস্ট্রিয়া ও লিশটেনস্টাইন, দক্ষিণে ইতালি এবং পশ্চিমে ফ্রান্স। এখানে পর্বত, পাহাড়, নদী ও হ্রদের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে।

দেশটির রাজধানী শহর বের্ন। এছাড়া বিখ্যাত শহরগুলোর মধ্যে জেনেভা এবং জুরিখ অন্যতম। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাঙ্ক। সুইজারল্যান্ডের আয়তন ৪১ হাজার ২৮৫ বর্গকিলোমিটার। আয়তনে ছোট হলেও দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ।

দক্ষিণের মাগগিওরে হ্রদের তীরে সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ১৯২ মিটার উঁচুতে রয়েছে পাইন অরণ্যের সারি। সেখান থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে ৪ হাজার মিটারেরও বেশি উঁচু ৪৮টি বরফাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। সুইজারল্যান্ডকে জুরা, সুইজারল্যান্ডীয় মালভূমি এবং আল্পস পর্বতমালা এই তিনটি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়।

২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ৮৩ লাখ ৭২ হাজারের অধিক মানষ বসবাস করে। সুইজারল্যান্ড বহুভাষী রাষ্ট্র এবং এখানে চারটি রাষ্ট্র ভাষা রয়েছে- জার্মান, ফরাসি, ইতালীয় এবং রোমানীয়। বাকিরা স্পেনীয়, পর্তুগিজ আর তুর্কী ভাষায় কথা বলে। সুইজারল্যান্ডের শিক্ষার হার ১০০ শতাংশ। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সে শিক্ষা বাধ্যতামূলক।

সুইজারল্যান্ডের অধিকাংশ অধিবাসী রোমান ক্যাথলিক ধর্ম চর্চা করেন। এরা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এছাড়া মুসলমান, সনাতন, খ্রিষ্টান এবং ইহুদীসহ অন্যরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করে।

এটি মূলত সরকারি এবং প্রশাসনিক শহর। শহরটি আরে নদীর বাঁক দ্বারা তিন দিকে বেষ্টিত একটি উঁচু শৈলান্তরীপের ওপর অবস্থিত। শহরের পুরাতন এলাকাগুলোকে পথচারীদের ভ্রমণের জন্য পরিবর্তিত করা হয়েছে এবং এগুলো থেকে আল্পস পর্বতমালার অসাধারণ সব দৃশ্য অবলোকন করা যায়।

বের্নে সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল, ভারী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ এবং চকলেটের কারখানা আছে। প্রতি বছর বের্ন শহরে দুইটি বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আরও আছে ঘোড়া ও গবাদি পশুর একটি বড় বাজার।

বের্ন শহরে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার লোকের বাস। এটি জনসংখ্যার দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের ৫ম বৃহত্তম শহর। বের্ন শহরের প্যাটেন্ট অফিসে কেরানিগিরি করার সময়েই আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্বের রূপরেখা দাঁড় করান।

সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষতার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। তবে ১৮১৫ সালের পর থেকে দেশটিতে কোনো যুদ্ধ হয়নি। তাছাড়া বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সুইজারল্যান্ড আক্রান্ত হয়নি। ১৯২০ সালে সুইজারল্যান্ড জাতিপুঞ্জের সদস্য হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি সুইজারল্যান্ড আক্রামণের পরিকল্পনা করলেও তারা কোনো প্রকারের আক্রমণ করেনি। ১৯৬৩ সালে দেশটি ইউরোপের কাউন্সিলে যোগ দেয়। এছাড়া রেড ক্রস, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ এখানে বহু আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সুইসব্যাংকে কালো টাকা নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য কুখ্যাতি থাকলেও সুইজারল্যান্ডের ঘড়ি, ট্রেন এবং চকলেট খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। দেশটির কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী নেই। দেশটির রাজনৈতিক অবস্থা ভারসাম্যমূলক ও অত্যন্ত স্থির।

সুইস সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবছর ১ জানুয়ারি তারিখে দেশটির রাষ্ট্রপতি পরিবর্তিত হয়। ছয় বৎসরের জন্য গঠিত মন্ত্রীপরিষদের একেক জন মন্ত্রী এক বৎসরের জন্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

ইউরোপের পাহাড়ী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সুইজারল্যান্ড। এর আয়তনে ৭০ শতাংশ ঘিরে রয়েছে আল্পস। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু পর্বত মন্টি রোজা গ্রীষ্মকালে গরম আর আদ্র থাকে। এই সময় পর্যায়ক্রমিকভাবে বৃষ্টি হয়। শীতকালে পর্বতগুলোতে বিকল্প রোদের সাথে বরফ থাকে, যখন নিচের এলাকাজুড়ে মেঘলা আর কুয়াশার প্রবণতা দেখা যায়।

পর্যটকরা সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের জন্য আকৃষ্ট হয়। এছাড়া স্কিইং আর পর্বত ভ্রমণের জন্য এখানে অনেক পর্যটক আসে। বিশ্বের অন্যতম অর্থসংস্থান হওয়ায় এখানে বহু ভ্রমণকারী ব্যবসার জন্য আসে। সুইজারল্যান্ডে বার্নের পুরাতন শহর, সাধু গলের মঠ এবং এবং মন্টি স্যান জিওরজিও সহ ১১টি ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে।

স্কিইং, স্নোবোর্ডিং এবং মাউন্টটেইনিং সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এছাড়া দেশটির পরিচিত খেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুটবল, আইস হকি, টেনিস ইত্যাদি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারশেন অব অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল বা ফিফা এবং ইন্টারন্যাশনাল আইস হকি ফেডারেশনের সদর দপ্তর দেশটির জুরিখ শহরে অবস্থিত।

এখানে আছে বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক রিসোর্ট এবং হাইকিং, বাইকিং, ক্লিম্বিং, স্কিইং, প্যারাগ্লাইডিং ও স্লেজ গাড়িতে চড়ার সুবিধা।

আল্পস পর্বতের সবচাইতে উঁচু চূড়ার একটি হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের মেটারহর্ন। এই আইকনিক চূড়াটির উচ্চতা ৪৪৭৮ মিটার। ১৮৬৫ সালে প্রথম এই শৃঙ্গে উঠার সময় ৪জন আরোহী দুঃখজনক ভাবে মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে গরমের সময়ে হাজার হাজার অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এই স্থানটিতে যান।

এই পর্বতের পাদদেশে মনোমুগ্ধকর গ্রাম জারমেটে অবস্থিত শীর্ষ আন্তর্জাতিক রিসোর্টগুলোর একটি। এখানে আছে ঘোড়ায় টানা গাড়ী, কাঠের তৈরি বাড়ি, বিশ্বমানের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট। বাতাসের গুনাগুণ ঠিক রাখার জন্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এখানে মোটরচালিত যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। শীতের সময়ে স্কিইং করার সময় ৩০০ কিলোমিটার ঢালে চলে যেতে পারে মানুষ।

গ্রীষ্ম বা শীত উভয় ঋতুর জন্যই সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো জায়গা গুলোর একটি জাংফ্রো অঞ্চল। এক বা দুই শতাব্দী আগেও দুঃসাহসী অভিযাত্রীরাই কেবল আল্পস পর্বতারোহণের জন্য যেতো। বর্তমানে রেলপথের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, সুন্দর হাঁটার বা বাইকে চলার পথ বিভিন্ন ধরণের পর্যটকের জন্যই সহজগম্য।

গ্রিন্ডেলওয়াল্ড, মুড়েন, লটারব্রুনেন এবং ওয়েঙ্গেন নামের ৪টি চিত্রানুগ শহর এবং ইগার, মনচ ও জাংফ্রু নামের নয়নাভিরাম ৩টি পর্বত নিয়ে জাংফ্রো অঞ্চল গঠিত। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেল ভ্রমণ হল ক্লেইন স্কেইডেক পর্বত থেকে ইগার ও মনচ পর্বতের মধ্য দিয়ে জাংফ্রোজস পর্যন্ত যাওয়া। এই রেল ট্রিপ এর রেলগাড়িটির নাম জাংফ্রুবান।

ইন্টারলাকেন ঘড়ি তৈরির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে পর্যটন রিসোর্ট হিসেবেও জনপ্রিয়। ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে পর্যটকেরা ইন্টারলাকেনে যেতো পর্বতের নির্মল বায়ু সেবন ও স্পা ট্রিটমেন্টের জন্য।

সুইজারল্যান্ডের ৩টি বিখ্যাত পর্বতের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা ছাড়াও এটি আল্পস পর্বতের বেসক্যাম্প হিসেবেও জনপ্রিয়। যেসব পর্যটকরা ভিন্ন কিছু করতে চান তারা সেখানকার কাঠ খোদাই করা স্কুলে এক বা দুইটি ক্লাস করেন। ক্ষুধার্ত পর্যটকেরা এখানে আলু ও পনির দিয়ে তৈরি ক্লাসিক সুইস ডিশ রাস্লেট খেয়ে থাকেন।

অনেক পর্যটকের জন্যই লুসারন হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের সারভাগ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় অংশের প্রবেশদ্বার হচ্ছে লুসারন। লেক লুসারনের ছবির মত সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং এর নীচেই দেখা যায় আল্পসের চমৎকার দৃশ্য। চিত্রানুগ পুরনো এই শহরটি গাড়ী মুক্ত, এই শহরের মাঝখানে চিত্রাঙ্কন সম্বলিত আচ্ছাদনসহ একটি কাঠের তৈরি মধ্যযোগীয় সেতু আছে যা ইউরোপেরও সবচেয়ে প্রাচীন সেতু।

এখানকার ঐতিহাসিক বাড়িগুলো দেয়াল চিত্রে সজানো থাকে এবং এখানে আছে চমৎকার টাউন স্কয়ার। এগুলো দেখার পর আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন কেন লুসারন ভ্রমণ বিলাসী মানুষের কাছে সারা বছরই জনপ্রিয় থাকে। এখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা পাশাপাশি অবস্থিত। উদ্ভাবনী নকশার জন্য সুনাম অর্জন করেছে এই শহর।

ফ্রান্সের আর্কিটেক্ট জিয়ান নওভেল এর নকশায় নির্মিত কেকেএল নামের স্থাপত্যটি এই শহরের স্থাপত্যকলার উজ্জ্বলতম নিদর্শন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সদর দপ্তর জেনেভায় অবস্থিত। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি এবং জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। এছাড়াও আরো ২০ টি আন্তর্জাতিক সংগঠন আছে এখানে।

পরিবেশবাদী পর্যটকদের জন্য জেনেভা আদর্শ স্থান। কারণ জেনেভা “গ্রিন সিটি” বা “সবুজ শহর”। এই শহরের ২০% জমি উদ্যানের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। এজন্য একে “পার্কের শহর” ও বলা হয়। ইউরোপের সর্ববৃহৎ আল্পাইন হ্রদ হচ্ছে জেনেভা হ্রদ যা সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত।

সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর। এখানে ৫০টি যাদুঘর ও ১০০টি আর্ট গ্যালারি আছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সুইস ব্র্যান্ডের পণ্য কিনতে কিনতে ভ্রমণকারীরা যখন ক্লান্ত হয়ে যান তখন লেক জুরিখে নৌকা ভ্রমণে যেতে পারেন অথবা কাছাকাছি পাহাড়ে আরোহণ করতে পারেন। সুইজারল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে উৎসর্গ করে নির্মিত রুপকথার দুর্গ “সুইস ন্যাশনাল মিউজিয়াম” দেখার কথা ভুললে চলবে না।

ছবির মত সুন্দর মধ্যযুগীয় শহর বার্ন সুইজারল্যান্ডের রাজধানী যার আছে ১২শ শতকের পুরোনো ইতিহাস। ১৬শ শতাব্দীর আগে এরা সুইস সঙ্ঘের সাথে যুক্ত হয়নি। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে প্রাচীন ক্লক টাওয়ার যাতে চলন্ত পুতুল আছে। অন্য জনপ্রিয় স্থান গুলো হচ্ছে মুনস্টার, গোথিক ক্যাথেড্রাল এবং টাউন হল। ইউরোপের দীর্ঘতম আচ্ছাদিত শপিং এলাকা এই প্রাচীন নগরে অবস্থিত যা চার মাইল দীর্ঘ।

“সুইজারল্যান্ডের মন্টিকার্লো” নামে খ্যাত লুগানো, লুসেইন যা লর্ড বায়রন, শেলি ও আরনেস্ট হেমিং ওয়ের মত লেখকদের জন্মস্থান, “সিটি অফ আর্ট” নামে খ্যাত বাসেল, এঙ্গাডিন সেন্ট মরিটজ, মজাদার খাবার ও ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত টিসিনো অঞ্চল গুলোও সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের জন্য চমৎকার স্থান।

ভয়েসটিভি/এএস

You may also like